বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬, ০৬:০৯:১২

মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় বিমানবন্দর!

মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় বিমানবন্দর!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফিরে এল আতঙ্কের চেনা ছবিটা। পর পর তিনটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো তুরস্কের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দর ইস্তাবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দর। পর পর গুলি আর আত্মঘাতী বোমায় মুহূর্তে লন্ডভন্ড হলো বিমানবন্দর। নিহত ৪১ জনের মধ্যে ১৩ জনই বিদেশি নাগরিক। আহত ২৪০। আর মঙ্গলবার রাতে ইউরোপের তৃতীয় ব্যস্ততম এই বিমানবন্দরের রক্তস্রোত জনমানসে উস্কে দিয়ে গেল ব্রাসেলস হামলার স্মৃতি!

পুলিশ সূত্র আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জানা যায়, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত ১১টা নাগাদ আতাতুর্কের আন্তর্জাতিক টার্মিনালে ঢুকে পড়ে কালো পোশাক পরা তিন জঙ্গি। একে-৪৭ উঁচিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, টার্মিনালের দু’টো জায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে হামলা চালায় জঙ্গিরা। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে আন্তর্জাতিক টার্মিনালের এক তলায়। দ্বিতীয়টি দোতলায়। আর তৃতীয়টি গাড়ি রাখার জায়গায়। পাল্টা আক্রমণে নামে পুলিশও। তবে সেই লড়াই চলেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। পুলিশ পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করার বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথম আত্মঘাতী বিস্ফোরণটি ঘটায় জঙ্গিরা।

উড়ে যায় বিমানবন্দরের একটা অংশ। চিৎকার, কান্নার রোল আর বিস্ফোরণের কানফাটানো শব্দে আতঙ্ক ছড়ায়। চোখের সামনে দুই জঙ্গিকে গুলি ছুড়তে দেখেছেন যাত্রী ডায়না এলটনার। তার কথায়, ‘বাচ্চারা কাঁদছে, লোকজন চিৎকার করছে। ভাঙা কাচ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ভয়ঙ্কর অবস্থা তখন। ভয় আর আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা ৭৭ বছরের পল রসও বলছেন আতঙ্কের কথাই।

তিনি বলেন, ‘মাত্র মিটার পঞ্চাশ দূরে দাঁড়িয়েছিল ওরা। কালো পোশাক। আমরা একটা কাউন্টারের পিছনে লুকিয়ে ছিলাম। তবে দেখতে পেয়েছি পুরো তাণ্ডবটা। প্রথমে গুলি, তার পর বিস্ফোরণ।’ পুলিশি তৎপরতায় বিমানবন্দরের বাইরে বেরোতে পারলেও চাপ চাপ রক্তের দাগ আর মৃত্যুভয় পিছু ছাড়ছে না স্টিভেন নাবিলের। ইরাকি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক স্টিভেন বললেন, ‘জীবনের সবচেয়ে লম্বা ৪৫ মিনিট। এত রক্ত, এত হাহাকার ভুলতে পারছি না!’

আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গিদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিমানবন্দরের দখল নেয় পুলিশ। বের করে আনা হয় যাত্রীদের। বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমান পরিষেবা। তবে বুধবার রাতের দিকে আংশিক ভাবে ফের পরিষেবা চালু হয়েছে। কারা এই হামলার পিছনে রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি। প্রাথমিক ভাবে এর পিছনে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হাত রয়েছে বলেই মনে করছে প্রশাসন। নিহতদের ১৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ওই বিমানবন্দরের কর্মী, সদ্যবিবাহিত এক দম্পতিও।

দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে শুধু সন্ত্রাস মোকাবিলাই নয়, বরং একজোট হয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার বার্তা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগান। তার কথায়, ‘যদি সব রাষ্ট্র এবং প্রত্যেকটি মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হাতে হাত না মেলায়, তবে আমাদের মনের ভেতরের আতঙ্কগুলো একে একে হয়তো সত্যি হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রমজানের সময়ে এমন হামলা বুঝিয়ে দেয়, এদের কোনও বিশ্বাস, মূল্যবোধ নেই।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইস্তাবুলের হামলার নিন্দা করে বলেন, ‘আইএস যে কী নৃশংস, এই ধরনের হামলা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমাদের লক্ষ্য এমন কিছু পদক্ষেপ করা, যাতে এই ঘটনা কোথাও আর না ঘটে।’

ইস্তাম্বুলে ভয়াবহ সন্ত্রাসি হামলার নিন্দা করে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তুরস্কের পাশে থাকার বার্তাও দিয়ে মোদি এ হামলাকে ‘অমানবিক’ বলে বর্ণনা করেন।। পাশাপাশি, হামলার নিন্দা করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির মতো ব্যক্তিত্বরা। বিবৃতি প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ও।

কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী অবশ্য বুধবার রাত পর্যন্ত এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে আতাতুর্কে হামলার ছকের সঙ্গে মিল রয়েছে ইসলামিক স্টেটের সাম্প্রতিক বড় মাপের বিস্ফোরণগুলোর। আতাতুর্কের হামলার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে গত মার্চে ব্রাসেলসের বিমানবন্দরে হামলার নকশা! আর তাতেই জোরালো হচ্ছে আইএসের যোগসূত্রের সন্দেহ।

কী রকম? ব্রাসেলসের জাভেন্তেম বিমানবন্দরেও ঢুকেছিল তিন জঙ্গি। তাদের দু’জন দু’স্যুটকেস ভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক প্রস্থান টার্মিনালে। চেক-ইনের লাইনে ঘটে প্রথম বিস্ফোরণ। ন’সেকেন্ডের মাথায় পরের বিস্ফোরণ। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছিলেন, আত্মঘাতি বোমার আগে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছু়ড়েছিল জঙ্গিরা। তৃতীয় জঙ্গি অবশ্য সে বার ধরা পড়ে যায়। প্যারিস-ব্রাসেলসের চেনা ছকে ইউরোপের ব্যস্ততম কেন্দ্রগুলোয় হামলা চালানোর এই ব্লু-প্রিন্ট এ ক্ষেত্রেও তাই সন্দেহের তালিকায় রাখছে সেই আইএস-কে!  

আর সেই সঙ্গেই ফিরে আসছে চেনা প্রশ্নগুলো। লাগাতার সতর্কতা সত্ত্বেও কী করে এমন ফাঁক রয়ে গেল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায়? কী ভাবে অস্ত্র আর আত্মঘাতী জ্যাকেট পরা জঙ্গিরা পৌঁছে গেল বিমানবন্দরের ভিতরে? ইসলামিক স্টেটের শিরোনামে আসার পর থেকেই সিরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন এ দেশে মাথাচাড়া দিয়েছে জঙ্গি হামলা। তবে বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন বড় মাপের হামলা এই প্রথম। ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গি নিধনে সামরিক জোটের অংশীদার তুরস্কও। ফলে, বাড়তি সতর্কতা ছিলই। তা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা স্বাভাবিক ভাবেই নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে প্রশাসনের তৎপরতা!

৩০ জুন ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে