আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ঈশান অবস্থির ত্রাতা হিসেবে অঙ্কন-শিক্ষক রামশঙ্কর নিকুম্ভ অনায়াসে হাজির হতে পারেন রুপোলি পর্দায়। কিন্তু বাস্তবে, অন্তত এই পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবে নিকুম্ভ স্যারেদের পক্ষে ঈশানদের পাশে দাঁড়ানো খুব সহজ নয়। ভারতের এ রাজ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিকুম্ভ স্যারেদের কেন নিয়োগ করা হচ্ছে না, তার সদুত্তর মিলছে না। তবে ওই পড়ুয়াদের বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধে সুনিশ্চিত করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
কী কী সুযোগ-সুবিধে দেওয়া হবে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের?
স্কুলশিক্ষা দফতরের বিজ্ঞপ্তি বলছে: l যে-সব পড়ুয়ার হাঁটতে-চলতে সমস্যা হয়, তাদের জন্য স্কুলভবনের একতলায় ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। একতলার সেই সব ঘর যদি খুব উঁচু হয়, সে-ক্ষেত্রে রাখতে হবে র্যাম্পের বন্দোবস্ত। l যাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, সেই সব ছাত্রছাত্রীকে সামনের সারির বেঞ্চে বসিয়ে পড়াতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের জন্য চাই বড় বড় হরফে ছাপানো পাঠ্যবই। l দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
শ্রেণিকক্ষ ও পাঠ-সরঞ্জামে সুবিধে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য পরীক্ষা-পদ্ধতিতেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। l পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষার নির্বাচন এবং দ্বিতীয় ভাষার প্রশ্নপত্রের গঠনে পরিবর্তন আনতে চাইছে সরকার। l বিজ্ঞান বা ভূগোলের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় ছবি, মানচিত্র এবং জ্যামিতির রেখাঙ্কনের ক্ষেত্রেও থাকবে বিকল্প প্রশ্ন। l বিশেষ চাহিদার পড়ুয়াদের চিহ্নিতকরণের জন্য উত্তরপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট ছাত্র বা ছাত্রীর বিশেষ প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা পর্যবেক্ষককে।
শিক্ষা শিবিরের বক্তব্য, প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধে নিশ্চয়ই দরকার। তবে সমান ভাবে দরকার নিকুম্ভ স্যার বা দক্ষ প্রশিক্ষকের। তার ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন? প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের যথাযথ ভাবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্পেশ্যাল বিএড পাঠ্যক্রমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজের অপেক্ষায় রয়েছেন কয়েক হাজার প্রার্থী। কিন্তু তাঁদের নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের তরফে কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
‘অল বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন ফর স্পেশ্যাল এডুকেশন টিচার’-এর তরফে সুরজিৎ রায় বলেন, ‘‘অন্যান্য রাজ্যে নবম থেকে দশম পর্যন্ত ‘ইনক্লুসিভ এডুকেশন অব দ্য ডিসএব্লড অ্যাট সেকেন্ডারি স্টেজ’ (আইইডিএসএস) প্রকল্পে বিশেষ প্রশিক্ষকদের নিয়োগ করা হলেও পশ্চিমবঙ্গে সেই কাজ আদৌ এগোচ্ছে না। খাতায়-কলমে নিয়মবিধি চালু হয়েছে। কিন্তু প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধে থেকে, বিশেষ করে প্রশিক্ষকের সাহচর্য থেকে পড়ুয়াদের বঞ্চিতই করে রাখছে সরকার।’’
বিশেষ প্রশিক্ষকের অভাবের কথা তুলে ধরেছেন বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্বপ্না সিংহও। তিনি বলেন, ‘‘র্যাম্প বা নির্দিষ্ট শৌচাগার, ট্রলি প্রভৃতির বন্দোবস্ত থাকলেও আমাদের বিশেষ প্রশিক্ষক নেই। আমরাই পড়াই। অথচ প্রশিক্ষক থাকলে অভিভাবকেরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হন। সে-ক্ষেত্রে তাঁরা এটা ভেবে আশ্বস্ত হতে পারেন যে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে বঞ্চিত হচ্ছে না।’’
এই ধরনের অভাব-অভিযোগের মধ্যে প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধে দিতে সরকার যে-ভাবে উদ্যোগী হয়েছে, সেটাকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক প্রধান শিক্ষক।
হাওড়া-বাউড়িয়ার বুড়িখালি ক্ষেত্রমোহন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত জানা বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে আগেই র্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষা দফতরের নির্দেশ মেনে বিকল্প ছোট প্রশ্নের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে।’’
পাঠভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায় জানান, স্থানাভাবে তাঁদের স্কুলে এখনও র্যাম্পের ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে খুব তাড়াতাড়ি র্যাম্প তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। ‘‘বিশেষ শিশুদের জন্য পরীক্ষায় ছোট ছোট প্রশ্ন রাখার নিয়মটি আমরা মেনে চলি,’’ বললেন সান্ত্বনাদেবী।
হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষার সামন্ত জানাচ্ছেন, তাঁদের স্কুলে এই ধরনের বিশেষ চাহিদার শিশুর সংখ্যা খুবই কম। রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান প্রকল্পে এই কাজগুলির জন্য নির্দিষ্ট অনুদান দেওয়া হয়।
‘‘তবে কত জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়া রয়েছে, সেই তালিকা পাওয়ার পরেই অনুদান মেলে। সেই ব্যবস্থা করতে সময় লেগে যায়। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না,’’ বলেন তুষারবাবু।
সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘এই নিয়ে বহু দিন ধরে আন্দোলন করছি। এত দিনে সরকার উদ্যোগী হল। তাদের উদ্যোগকে স্বাগত।’’
সেই সঙ্গেই কান্তিবাবুর অভিযোগ, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার নতুন করে একটা স্কুলও চালু করেনি। তা ছাড়া অনেক স্কুলেই র্যাম্প তৈরির জায়গা নেই। তা গড়ে তোলার জন্য সরকার টাকা দেবে কি? ‘‘এ-সব বিষয় পরিষ্কার না-হলে তো কোনও ভরসাই নেই,’’ বলছেন কান্তিবাবু। -আনন্দবাজার
১৩ জুলািই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম