আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নিজেকে ‘সুলতান’ বলে থাকেন তিনি। বলেন সহযোগীরাও। সামরিক অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে যাওয়ার পরে এ বার মুসলিম রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান তুরস্কের গোটা রাজনৈতিক পরিসরকে দখলে আনতে উদ্যোগী হলেন বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার সরকারের নানা কাজকর্মে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের নানা অংশে।
গদিচ্যুত করার বদলে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ব্যর্থ অভ্যুত্থান। তাই দেশের ইসলামপন্থী জনতার বড় অংশের সমর্থনের জোরে এখন তিনি গোটা দেশকে মুঠোয় আনার কাজ ভাল ভাবেই করতে পারবেন বলে ধারণা অনেকের। বিদ্রোহে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যেই শীর্ষ সেনাকর্তা, বিচারক, আইনজীবী-সহ প্রায় ৬ হাজার মানুষকে আটক করেছে এরদোগান সরকার। আটক সেনারা বাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ অংশের সমর্থক বলেই ধারণা অনেকের।
শুক্রবার রাতে সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টার সময়ে মোবাইলের ফেসটাইম অ্যাপের মাধ্যমে নাটকীয় ভাবে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এরদোগান। তার পরেই বিদ্রোহী সেনাদের মোকাবিলায় প্রেসিডেন্টের অনুগত বাহিনী ছাড়াও রাস্তায় নামেন সাধারণ মানুষ। এ দিনও ইস্তানবুল, আঙ্কারা-সহ বিভিন্ন শহরের রাস্তায় জাতীয় পতাকা নিয়ে বেরিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কারও পরনে ঐতিহ্যবাহী তুর্কি পোশাক। কেউ আবার এসেছেন টি-শার্ট আর বুট পরে। কারও কারও সঙ্গে ছিল ছোট ছেলেমেয়েরাও।
ইস্তানবুলের এক জমায়েতে এসেছিল ১৬ বছরের কিশোর গোজদে কার্ট। তার কথায়, ‘সেনার একটা ছোট্ট অংশ বিদ্রোহ করেছিল। গোটা তুরস্ক এক হয়ে তাদের হারিয়ে দিয়েছি।’ দেশের প্রথম সারির দুই সংবাদপত্রে গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনির ছড়াছড়ি। বিদ্রোহে নিহতদের শেষকৃত্যেও বিশাল জমায়েত হয়েছে আঙ্কারা, ইস্তানবুলে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন খোদ প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রচারের ম্যানেজার এরোল ওলকাক ও তার ছেলে। রোববার ইস্তানবুলে তাদের দাফন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এরদোগান। বিদ্রোহে নিহতের সংখ্যা ২৯০ জন বলে এ দিন জানিয়েছে সরকার।
প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা বাড়াতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তুরস্কের একটা অংশ ও পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে। তাদের মতে, বিদ্রোহীদের ‘উপযুক্ত শাস্তি’ দেওয়ার নামে সব বিরোধী সুরকেই দমন করার চেষ্টা করবেন ‘সুলতান’। ইতিমধ্যেই আটক ৬ হাজার মানুষের মধ্যে রয়েছেন সেনার একাধিক শীর্ষ কর্তা।
তাদের মধ্যে জেনারেল বেকির ইরকান ভান ও মেজর জেনারেল ওজহান ওজবাকির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জেনারেল ইরহান তুরস্কের ইনসিরলিক বিমানসেনা ঘাঁটির দায়িত্বে ছিলেন। ওই সেনাঘাঁটি থেকেই সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় আমেরিকা। অন্য দিকে মেজর জেনারেল ওজবাকির দক্ষিণ পশ্চিম তুরস্কের এক গুরুত্বপূর্ণ সেনাঘাঁটির দায়িত্বে। আটক সেনার মোট সংখ্যা ৩ হাজারের কাছাকাছি।
কিন্তু সেনা ছাড়াও বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র-সহ প্রশাসনের নানা স্তরের কিছু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে এরদোগান সরকার। এই অভ্যুত্থানের পিছনে আমেরিকায় নির্বাসনে থাকা ধর্মগুরু ফেতুল্লা গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি প্রেসিডেন্টের। বিচার বিভাগেই ফেতুল্লাহের অনুগামীর সংখ্যা বেশি বলে মনে করা হয়। অনেকের আশঙ্কা, এই সুযোগে ফেতুল্লার ঘনিষ্ঠ বিচারপতি ও আইনজীবীদের কব্জা করতে চাইছেন এরদোগান।
এরই মধ্যে আবার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পিছনে আমেরিকার হাত থাকার জল্পনায় বেড়েছে কূটনৈতিক উত্তেজনা। গত শনিবারই ফেতুল্লা গুলেনকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে আমেরিকাকে পরোক্ষে ঠুকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। রোববার আবার আমেরিকার ঘনিষ্ঠ ও ন্যাটোর সদস্য এই দেশটির শ্রমমন্ত্রী ইঙ্গিত দেন, অভ্যুত্থানের পিছনে আমেরিকা থাকতে পারে। ইনসিরলিক ঘাঁটিতে আমেরিকার বড় মাপের বাহিনী রয়েছে। সেই ঘাঁটির কম্যান্ডারই বিদ্রোহে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ায় জল্পনা আরও জোরদার হয়।
আবার ফেতুল্লা গুলেনকে প্রত্যর্পণের দাবি করেছেন এরদোগান। অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার জল্পনার তীব্রতা বাড়ায় কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকা। এ দিন মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে তুর্কি বিদেশমন্ত্রী মেভলুত কাভোসোগলুর। সেই কথোপকথনের নথি প্রকাশ করেছে মার্কিন বিদেশ দফতর। তারা জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের চেষ্টায় মার্কিন মদতের প্রচার যে একেবারেই ভুয়ো তা কাভোসোগলুকে জানান কেরি। ওয়াশিংটন তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকারের পাশেই রয়েছে।
কেরি জানিয়েছেন, ফেতুল্লার প্রত্যর্পণ নিয়ে যে ফের তুরস্ক উদ্যোগী হবে তা আমেরিকা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। আঙ্কারা থেকে নয়া কোনও অনুরোধ এলে তা অবশ্যই নতুন ভাবে বিবেচনা করা হবে। সরকার সূত্রে খবর, ফেতুল্লার প্রত্যর্পণের নয়া অনুরোধ তৈরি করছেন সরকারি আইনজীবীরা। -আনন্দবাজার
১৮ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস