বিনোদন ডেস্ক : পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা গানের জগতে পদচারণ সাবিনা ইয়াসমীনের। ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের আগুন নিয়ে খেলা ছবিতে আলতাফ মাহমুদের সংগীত পরিচালনায় ‘মধু জোছনা দীপালি’ গানটির মাধ্যমে প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম গান করেন রবীন ঘোষের সংগীত পরিচালনায় নতুন সুর ছবিতে। দীর্ঘ সংগীতজীবনে ১৬ হাজারও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ১৩ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বছর তিনেক আগে গুণী এই শিল্পীকে ডিসট্রেসড চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের (ডিসিআই) শুভেচ্ছাদূত করা হয়। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত এই শিল্পীর জন্মদিন। দিনটি নিয়ে ভাবনাসহ সংগীতজীবনের নানা দিক নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সাবিনা ইয়াসমীন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের
জন্মদিনটা সাধারণত কীভাবে কাটান? এবার কী পরিকল্পনা আছে?
আমি তিন বছর ধরে ডিসিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত আছি। এই সংগঠনের হয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত ও ছিন্নমূল শিশুদের উন্নয়নে কাজ করছি। কয়েক বছর ধরে সকালে ওরা আমার বাসায় আসে। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। গান শোনায়, নাচ দেখায় ও আমার সামনে ছবি আঁকে। ওদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা হয়। সন্ধ্যায় মেয়ে বাঁধন, আত্মীয়স্বজনসহ বাইরে খেতে বের হই। এবার সবই হবে, শুধু সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়া হবে না।
জন্মদিনটা আপনার কাছে কেমন?
খুবই আনন্দের। আবার যখন চুপচাপ ভাবি, আহারে বয়স, আরেকটা বছর বেড়ে গেল, তখন খুব মন খারাপ হয়। (হাসি)
২০০৭ সালে আপনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। অনেকেই বলেন, এরপর আপনি নতুন জীবন পেয়েছেন। সেই হিসেবে বলতে হয়, অসুস্থ হওয়ার আগের জীবন আর পরের জীবনের কোনো তফাত দেখেন কি?
নতুন জীবন পেয়েছি, একেবারে ঠিক। তবে দুই জীবনের মধ্যে আমি কোনো তফাত দেখি না। শুধু অসুস্থতার সময় আমার একটাই উপলব্ধি হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ আমাকে এত ভালোবাসেন! এটা কোনোদিন টেরই পেতাম না, যদি না অসুস্থ হতাম।
আপনার যদি পুনর্জন্মই হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় জন্মে কী করতে চান?
আমিযেসব সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি তাঁরা সবাই কিংবদন্তি। আমার চাওয়া, তাঁদের সেই গানগুলো আবার নতুন করে গাইব। অনেক ভালো কিন্তু কম প্রচলিত ওই সব গান নতুন করে গেয়ে তাঁদের সম্মান জানাতে চাই।
বাংলাদেশি সিনেমার গান, দেশাত্মবোধক গান ও অ্যালবামসহ নানা মাধ্যমে আপনার গাওয়া অসংখ্য গান রয়েছে। এই গানগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আছে?
আমি ১৬ হাজারের মতো গান গেয়েছি। আমার পক্ষে সব গান সংরক্ষণ করা সম্ভব না। রিমেক করেছি বলেই কিছু গান নিজে থেকে সংরক্ষণ করেছি। কিছু গান টেলিভিশন পর্যন্তই আছে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে চিন্তাও করি। আগ্রহী কেউ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে এত গান আমার পক্ষে সংরক্ষণ করা সম্ভব না। আমি কিন্তু সম্প্রতি আলতাফ মাহমুদ ভাই, যাঁর হাত ধরে গানের জগতে আসা, তাঁর ১০টা গান নতুন করে গাইছি। এগুলো প্রথম গেয়েছিলাম ১৯৬৭-৬৮ সালে। আলতাফ ভাই তখন একচ্ছত্রভাবে কাজ করছেন। তাঁর সুর ও সংগীতে অসংখ্য গান গেয়েছি। অনেক গান হারিয়েও গেছে। ইউটিউবে খোঁজ না পেলে তো এই গানগুলোর কথাও মনে করতে পারতাম না।
সংগীতজীবনে কার কার কাছে ঋণী?
আমি অর্ধশত সংগীত পরিচালকের গান করেছি। সবার কাছে আমার আজন্ম ঋণ। সবারই অনবদ্য কিছু গান আমি গেয়েছি।
আপনার ছোটবেলা কেমন ছিল?
মজার ছিল। আমরা পাঁচ বোন। সবাই মজার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। আমি দুষ্টামি করতাম সবচেয়ে বেশি। আমাকে সবাই বিরক্তও করত বেশি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে গানে হাতেখড়ি। আম্মার কাছে প্রথম গান শেখা। বড় বোন ফরিদা ও ফওজিয়া ইয়াসমীন যখন দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছেগানের তালিম নিত, আমি আর নীলু (নীলুফার ইয়াসমীন) পাশে বসে থাকতাম। এরপর তো ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে ১৩ বছর তালিম নিয়েছি। মাত্র সাত বছর বয়সে স্টেজ প্রোগ্রামে অংশ নিই। বাবার চাকরিসূত্রে আমরা তখন নারায়ণগঞ্জে থাকতাম।
বোনদের সঙ্গে কোনো স্মৃতি?
অনেক স্মৃতি। আমাদের ঘরের মধ্যে একটা মিটসেলফ ছিল। আমাকে একবার ওটার মধ্যে ঢুকিয়ে অন্য বোনেরা তালা মেরে দেয়। এরপর তো আমি চেঁচামেচি করে একাকার করে ফেলি। ছোটবেলায় আমার মাথায় অনেক চুল ছিল। প্রায়ই চুলে গিঁট লেগে যেত। মেজো বোন একবার কাছে ডেকে এনে চুলে চিরুনি আটকে দেয়। মাথার সব চুলে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এ নিয়ে বিরাট কাণ্ড হয়। আমার সঙ্গে বেশি ভাব ছিল নীলুফারের। তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতাম না। ওর স্কুলে একদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। বলে রেখেছিলাম আমাকে যেন অবশ্যই নিয়ে যায়। হঠাৎ দেখি কি, সে বাড়িতে নেই। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। জানতে পারলাম, আমাকে না বলে সে চলে গেছে। এরপর বাড়ি থেকে একদৌড়ে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল রেললাইন। পেছন থেকে কখন যে ট্রেন হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল, আমার সে খবর নেই। হঠাৎ আমাকে একজন লোক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। তা না হলে কী যে হতো আল্লাহ জানেন।
আপনার স্বপ্নের কথা শুনতে চাই?
আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। আমার পুরোটা জীবন কানায় কানায় পূর্ণ। এই জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। তবে আমি যেহেতু ডিসিআইয়ের শুভেচ্ছাদূত হয়েছি, এখন আমার একটাই চিন্তা এখানকার সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত বাচ্চাদের উন্নয়নের জন্য কিছু অবদান রাখা। -প্রথম আলো
০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম