এটিএম শামসুজ্জামান : নানাবাড়ি নোয়াখালীতে আমার জন্ম। তবে বেড়ে ওঠা ঢাকায়। মানে পুরান ঢাকায়। আগে বাবুবাজারের আরমানীটোলা মাঠের পাশে ভাড়া থাকতাম। সেই বাড়ির ভাড়া ছিল ছয় টাকা। পরে ১৯৫৬ সালে আমাদের সূত্রাপুরের বাড়িটি আট হাজার টাকায় কিনে নেন আব্বা।
ওই বছরই পরিবারসহ এই বাড়িতে চলে আসি আমরা। সেই সময় সম্পর্কে একটু ধারণা দিই, তখন একটা বড় সাইজের ইলিশ মাছের দাম ছিল চার আনা। আমার আব্বা বালাম চাল খেতেন। আমার হাতে ২০ টাকা দিয়ে পাঠাতেন এক মণ বালাম চাল নিয়ে আসার জন্য।
যা হোক, আমাদের বাসা সূত্রাপুরে থাকলেও আমার খেলার জায়গা ছিল আরমানীটোলা মাঠ। অবশ্য সেই সময় ওই মাঠ ব্যবহৃত হতো রাজনীতির মাঠ হিসেবে। পরে ওটা স্থানান্তরিত হলো পল্টন ময়দানে। অবশ্য তখন পল্টন ময়দান বলতে কিছু ছিল না—পুরোটা ফাঁকা মাঠ।
আমাদের সময়ে নিউ মার্কেট বলতে ছিল চকবাজার। ঈদের কেনাটাকা সব এখানেই হতো। আমরাও কিনতাম এখান থেকে। আমার আবার প্রতি ঈদেই জুতা কেনার বাতিক ছিল। তবে এখানেই সমস্যা—সব সময় আব্বা কিনে দিতেন বাটা জুতা। সেই জুতা তো সহজে ছেঁড়ে না। ঈদ চলে আসে কিন্তু জুতা ছেঁড়ার নাম নেই। একবার ঈদে জুতা কিনব, কথাটি আব্বাকে বলতে পারছি না। কারণ জুতা তো ছিঁড়েনি। কী করি—একদিন রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন রান্নাঘরে বঁটি নিয়ে জুতা কেটে দুই ভাগ করলাম।
সকালবেলা দেখালাম আব্বাকে। দেখে তিনি ঠিকই বুঝলেন, এটা ছিঁড়ে যায়নি, কাটা হয়েছে। তবে কিছু বললেন না। আমার লোভ ছিল ক্যাপসুন জুতার ওপর। বায়না ধরলাম সেই জুতা কেনার জন্য। রাজি হলেন না আব্বা। পরে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনলাম জুতাজোড়া। শুধু কি কিনেই শেষ—অতঃপর ওই জুতা সারা রাত বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিলাম।
তারপর ঈদের দিন পায়ে দিয়ে বের হলাম বাইরে। হাঁটি আর তাকিয়ে থাকি পায়ের দিকে, নোংরা হলো কি না!
ঈদ ঘিরে অনেক দুষ্টুমির ঘটনা আছে আমার। ঈদের আগের দিন আব্বা স্টেট ব্যাংক থেকে চার আনা আর আট আনার পয়সা এনে রাখতেন। আমার কাজ ছিল ঈদের দিন সেগুলো গরিব-ফকিরদের বিলিয়ে দেওয়া। আব্বা বলে দিতেন, বয়স্ক ফকির দেখলে আট আনা আর জোয়ান ফকির দেখলে দিবি চার আনা। তো ঈদগাহ মাঠ থেকে ঘরে ফিরে খেয়েদেয়ে আমাকে আব্বা বসিয়ে দিতেন বাড়ির দরজার সামনে। কিন্তু ওই বসানো পর্যন্তই। ১৫-২০ মিনিট পয়সা বিলি করতাম আমি, তারপরই হাওয়া—বাকি সব টাকা চলে যেত আমার পকেটে। এক দৌড়ে চলে যেতাম সোজা লায়ন সিনেমা হলে। তখন এই সিনেমা হলে, এক টিকিটে তিন ছবি দেখাত। ব্ল্যাকে টিকিট কেটে ঢুকে যেতাম সেখানে। আমার কাছে ঈদের মজা ছিল সিনেমা দেখা। কত ঈদ যে সিনেমা দেখে কাটিয়েছি!
এসব দুষ্টুমির কারণে আব্বা আমাকে রাজশাহীতে চাচার বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ঈদ বা স্কুল বন্ধ হলেই তো চলে আসতাম ঢাকায়, ঈদ করতাম পরিবারের সঙ্গে।
আমার মা দারুণ সব রান্না করতেন। এই রান্নার লোভেই ঢাকায় আসা হতো আমার। কোরমা-কালিয়া...আহা! স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
ঈদের দিন আব্বা সালামি দিতেন এক আনা। বাড়ির মুরব্বিরাও দিতেন ওই পরিমাণ। সেই সময় হোসনি দালানে বসত কোরবানির পশুরু হাট। আব্বার সঙ্গে হাটে যেতাম। একবার ১২৫ টাকা দিয়ে আব্বা কিনে ফেললেন হাটের সবচেয়ে বড় গরু। সেটা নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম বাড়ি। পাশে দিয়ে দুটি ছাগল নিয়ে যাচ্ছিল একজন। কী যেন হলো—হুট করে ছাগল লাফ দিয়ে পড়ল আমার ওপর। ছাগলের শিং বিঁধল চোখের পাশে। সব মিলিয়ে সে এক কাণ্ড বটে। সেবার ঈদ খুব খারাপ কেটেছিল।
ঈদে এখন আর আগের মতো আনন্দ পাই না। নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে থাকি। চুপচাপ। আর বের হওয়া হয় না। আত্মীয়স্বজন আসেন দেখা করতে। তাদের সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। টিভিতে ভালো কোনো অনুষ্ঠান হলে দেখি—এই তো।
একসময় পুরান ঢাকায় ঈদের সবচেয়ে বড় দিক ছিল হিন্দু-মুসলমানের বন্ধন। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল। ঈদের দিন ওরা আমাদের বাড়িতে আসত। একসঙ্গে বসে খেত। আমিও যেতাম ওদের পূজা-পার্বণে। আমরা ছিলাম পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। এই এলাকার সব বাড়ির রান্নার ঘর অবধি আমার যাতায়াত ছিল। কে হিন্দু, কে মুসলমান—সেসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। সেই আবহাওয়া এখন একটু কমে গেছে, খানিকটা নষ্ট হয়েছে হয়তো। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সবকিছু। প্রথম আলো
লেখক : প্রবীণ অভিনয়শিল্পী
অনুলিখন: হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি