বুধবার, ০৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৪৮:২৫

ডেমরার ম্যারাডোনা আজকের সাইফ চন্দন

ডেমরার ম্যারাডোনা আজকের সাইফ চন্দন

তির্থক আহসান রুবেল : ইদানিং খুব নাম শোনা যাচ্ছে সাইফ চন্দনের। ফেসবুক বা ইউটিউব সব জায়গাতেই ‘থেরাপী’ শিরোনামের একটি গানের জয় জয়কার। গানটি চন্দনের ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’ সিনেমার। চন্দন সিনেমাটির নির্মাতা। যদিও এখনো মুক্তি পায়নি সিনেমাটি। তাতে কি! ইউটিউবে ছাড়ার পর গানটি জয় করেছে সিনেমা পাগল দর্শকদের। যারা নিয়মিত হলে বসে বাংলাদেশী সিনেমা দেখে কিংবা যারা বহুদিন হলে চৌকাঠ পেরোয়নি সবাইকেই আকর্ষণ করেছে গানটির ভিডিও বা গানটি। হঠাৎই কাকতালীয় ভাবে সন্ধান পেলাম চন্দনের। তাহলে আর জীবনের গল্প জানতে দেরী কিসের!

কলেজে পড়াকালীন একটি দৈনিক পত্রিকাতে বিনোদন সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু করেন চন্দন। চলার পথে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে থাকে। তেমনই একটি ঘটনা ঘটে বিশ্ব ভালবাসা দিবসের বিশেষ এ্যসাইনমেন্ট করতে গিয়ে। মিডিয়ার কয়েকটি জুটির ভালবাসার গল্প তুলে আনার দায়িত্ব পেলেন চন্দন। তৎকালীন জনপ্রিয় জুটির মধ্যে শাহেদ শরীফ খান এবং নাতাশা জুটি অন্যতম। শাহেদ শরীফ খান কয়েকটি বাক্যে নিজের ভালবাসার কথা জানান নাতাশার উদ্দেশ্যে। খুবই আলোড়িত হয় বাক্যগুলো। শাহেদ-নাতাশা জুটির পথচলার গল্পের শুরু নতুন করে, নতুন ভালবাসায়। বদলে যায় দৃশ্যপট। শাহেদ শরীফ খান তখন তুমুল ব্যস্ত, জনপ্রিয় অভিনেতা এবং মডেল। মাঝেমধ্যে পরিচালনাও করে যাচ্ছেন। এত ব্যস্ততার মাঝে তিনি একদিন বলে বসলেন, ‘তুমি আমার টিমে কাজ করতে পারো’। সেই শুরু খবর সংগ্রহের পাশাপাশি ক্যামেরার পেছনে কাজ করার হাতেখড়ি।

প্রথমে নাটকের পরিচালকের সহকারী, তারপর নিজেই একদিন পরিচালক হিসেবে নির্মাণ করলেন জীবনযাপন, বোকা প্রেম, ছেলেটি, আকডুম বাকডুম, ফোর্থ ক্লাস সোসাইটি, দলছুট, আমি তুমি তুমি আমি, সারাংশ, অপুর সংসার, ট্রাফিক সিগনাল ইত্যাদি। কিন্তু নির্মাণের সাথে জড়িত প্রতিটা মানুষেরই স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁয়ার। সাইফ চন্দনও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বপ্ন বাসা বাধে বড় পর্দায় নিজের সৃষ্টি দেখার। গল্প নিয়ে ভাবতে থাকেন। স্ক্রীপ্ট মাথায় আসে, আবার বের হয়ে যায়। এমন কিছুর নির্মাণ চাই, যা দর্শকরা গ্রহণ করবে। দর্শকদের সাথে প্রতারনা করার কোন ইচ্ছেই নেই। দীর্ঘদিন বিনোদন সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নানা পরামর্শ দিচ্ছে সঙ্গোপনে। কিন্তু আসলেই দর্শক কি চায়! কোন একদিন অবচেতন মন জানান দিলো, দর্শক চায় বিনোদন। দর্শক চায় আড়াই ঘন্টা জীবনের ক্লান্তি, শ্রান্তি, অবসাদকে দূরে রাখতে। দর্শক চায় একটু আয়েশ-আমোদ। সাইফ দর্শকের চাওয়াকে পূরণ করতে রচনা করলেন একটি পান্ডুলিপি। নাম দিলেন ‘ছেলেটি আবোল তাবোল, মেয়েটি পাগল পাগল’।

পেশাগতভাবে তখন তিনি এমন একটি পত্রিকায় জড়িত যেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে সাংবাদিকতা করা ডাকসাইটে একজন সাংবাদিক কর্মরত। তার নাম আওলাদ হোসেন। দেশের নামী প্রভাবশালী তারকারা তার বন্ধু। এমন একটা মানুষ থাকা সত্বেও সাইফ সুযোগ পেলেন চলচ্চিত্র নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের। হয়ত সেদিনই আরো কিছু লেখা হলো সাইফের কপালে। উদার সহযোগীতা আর পরামর্শ দিয়ে পাশে দাঁড়ালেন আওলাদ।

‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’ সিনেমাটি করতে গিয়ে সেই মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্থনৈতিক সংকট গ্রাস করতে চায় তাকে। কিন্তু থেমে গেলে তো চলবে না। স্বপ্ন যে আকাশের চেয়েও উঁচুতে রাখতে হয়। এগিয়ে এলেন এক বন্ধু শামীম আহমেদ। প্রযোজক হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে। অল্প অল্প করে প্রায় এক বছর ধরে সিনেমা ধারণ করে গেলেন ক্যামেরায়। এভাবেই কিছু বন্ধুর সহযোগীতায় একদিন প্যাকআপ হলো সিনেমাটি।

একটা মজার তথ্য এখানে এখানে যোগ করা যাক। নাটকের সুটিং-এ গিয়ে সাইফ খাওয়া দাওয়া বিশ্রামের সময় পাচ্ছিলেন না। নবীন পরিচালক কাজ করছেন সিনিয়রদের সাথে। বয়স এবং চেহারার কারণে সবাই তাকে তুমি তুমি সম্বোধনেই কাজ করছিলেন। কখনোবা একটু উল্টো খবরদারীও যেন রয়েছে। কাজের চাপে দিন কয়েক সেভ করা হয়নি সাইফের। এই দিন ৫/৭ এ কিছুই পরিবর্তন হয়নি। শুধু নাকের নিজে জাদরেল একটি গোঁফ বাসা বেধেছে। আগেই বলেছি, সময় না পাওয়ায় এমনটা ঘটেছে। কিন্তু সেটে বদলে গেল হাওয়া। আগে যারা তুমি সম্বোধন করতো, তাদের অনেকে আপনি সম্বোধন শুরু করলেন। কদিনে হঠাৎ সিনিয়র হয়ে গেলেন সাইফ। ডিরেক্টর বলে কথা! একটু বড় তো লাগতেই হবে! শুরু করলেন জাদরেল গোঁফধারীর জীবনযাপন। মজার আরেকটি তথ্য। ডেমরা এলাকাতে ম্যারাডোনা বলে একটা ছেলের ব্যাপক পরিচিতি। ফুটবল খেলতেন এক সময়। খ্যাপে আশেপাশের এলাকায় ফুটবল খেলতে চলে যেতেন। শারিরিক গঠন, মুখের ছবি সবকিছুতেই কিছুটা যেন ম্যারাডোনার ছাপ। সেই ছেলেটির বাবা একদিন এক কাজে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাকে দেখেই একজন বলে বসলেন, ‘আপনি ম্যারাডোনার বাবা না’! সেই ভদ্রলোক অর্থাৎ ম্যারাডোনার বাবা মূলত সাইফ চন্দনের বাবা। আর ম্যরাডোনা…! অদ্ভুত আরেকটা ব্যপার হচ্ছে দু দশক আগের বাবা-ই যেন ফিরে এসেছেন দু দশক পর ছেলের মুখশ্রীতে। ফেসবুকের কল্যাণে সেই অদ্ভুত ছবিটি অনেকেরই দেখা।

ভাগ্যে ভরসা কতটা! ভাগ্য যেখানে প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় ফেলেছে। ভাগ্য তাকে কঠিনতর পরীক্ষায় ফেলেছিল এক সময়। জীবনের চরমতম সঙ্কটকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তখন বড়ই অচেনা চারিধার। বহুদিনের পেশাদারিত্বের খাতিরে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলো ঠুনকো হয়ে যায়। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কেউ কারো নয়। সম্ভব কি এর মাঝে থেকে জীবনের হিসেব মেলানো! না! সাইফ চন্দন হিসেব মেলানোর জটিল সমীকরণে যান নি। তিনি সে অবস্থাতেই লিখে বসলেন সিনেমার স্ক্রীপ্ট। জীবনের বন্ধুর পথ যে সময় ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বড়ই অদ্ভুত সে সময়। কেউ যেন চিনে না তাকে। নতুন জন্ম নেয়া শিশুর তবু কিছু পরিজন থাকে। সাইফের সে পরিজনও যেন নেই। বান্ধব রিয়াজুল রিজু আগের মতোই পাশে। তবে জীবনের গতিপথ পাল্টে দিল আরশাদ আদনান। আরশাদ আদনান নাটকের ব্যস্ততম প্রযোজক। ইদানিং সিনেমা প্রযোজনাও শুরু করেছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন সাইফের দিকে। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা ঠিক এখানেই শুরু। আরশাদ আদনানেন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনা করার ঘোষণা দিলেন সাইফের নতুন চলচ্চিত্রের। কাজ শেষ করলেন ‘টার্গেট’ এর। বাংলার কিং খান খ্যাত শাকিব খান এবং তার সফল পার্টনার অপু বিশ্বাসকে নিয়ে ঘোষিত হলো সাইফের নতুন চলচ্চিত্র ‘বাজিকর’ এর। অন্যদিকে কাছাকাছি সময়ে সেন্সর বোর্ডে প্রশংসিত হলো সাইফের সিনেমা ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’। এ শুক্রবার সিনেমাটি আসছে হলে। এদেশের যারা নিয়মিত দর্শক তারা তো হলে আসবে! কিন্তু যারা ভাল সিনেমা চাই বলে সারাদিন চিৎকার করে তারা আবার হলে আসে না। ফলে কিছুটা হলেও চিন্তা থেকেই যায় স্বপ্নের সেই ফসল কতটা দর্শকের কাছে পৌঁছবে এই ভাবনায়।

ঠিক এরকম একটা সময় সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লেগে গেল। খুব ব্যস্ততায় দিন কাটছিল সাইফের। পরের সপ্তাহে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সিনেমার মহরত থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুতে অভিভাবক হিসেবে সাথে ছিলেন বিশিষ্ট সিনেমা সাংবাদিক আওলাদ হোসেন। সেদিন রাতেও সাইফের টিমের সাথে বসে হল ঠিক করছিলেন, প্ল্যানিং ঠিক করে দিচ্ছিলেন। গত দশ বছর এভাবেই তিনি নানাভাবে আগলে রেখেছেন সাইফকে। মিটিং শেষে বাসায় ফিরে গেলেন আওলাদ হোসেন। সেই রাতেই (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে) মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ইন্তেকাল করেন তিনি। মূহুর্ত্বে থমকে গেল সাইফের পৃথিবী। চোখে শুধুই অন্ধকার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অভিভাবক শুধু না, ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’ সিনেমার প্রায় পুরো দায়িত্বও স্নেহ-মমতা-ভালবাসা দিয়ে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। আজ আওলাদ হোসেন নেই। কিন্তু সিনেমাটির প্রতিটি অবস্থানে আওলাদ হোসেনের স্নেহ জড়িত থাকবে।

খুব আবেগী হয়ে উঠছে সময়টা। তাই একটু হালকা করতে ভিন্নরকম প্রশ্ন তুললাম। জানতে চাইলাম, ফেসবুকে আপনার এত সেলফি কেন! হাসতে হাসতে জবাব, আমি সেলফিটা ভাল তুলতে পারি, তাই আমার ছবির বাইরে অন্যদের ছবিও আমাকে তুলে দিতে হয় অনুরোধে বা ধমকে। ফলে অনেক ছবিতে আমার অবস্থান। শেষ প্রশ্নটায় ছিল কি হতে চান! এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফের উত্তর, ‘আমি আমার বাবার মতো হবো। বাবার চলা, বাবার বলা, বাবার মতো স্মার্ট, ড্যাসিং লুক, বাবার মতো মানুষ।’
০৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে