আমাদের বাংলা সিনেমা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
সীমান্ত প্রধান : চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদন মাধ্যমের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম। ছোট বেলায় মা-খালারা দলবদ্ধ সিনেমা দেখতে যেতেন। আমিও পিছু নিতাম।
ছোট ছিলাম বুঝতাম না। তবে সিনেমা থেকে আমি তখন বেশি উপভোগ করতাম মা-খালাদের মুখ। খেয়াল করতাম, তারা পুরো ছবিজুড়ে উত্তেজিত হচ্ছেন। আনন্দিত হচ্ছেন। আবেগী হয়েও কেঁদে ফেলছেন! আবার খিল খিল করে হাসছেন!
তখন না বুঝলেও এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি, চলচ্চিত্র আসলে এমনই হতে হবে। ধরে নিতে পারি সিনেমার গল্পটি হবে একটি খোলা উদ্যানের মত। যেখানে দর্শক দৌড়বে, হাঁটবে, খেলব, নিজের মতো করে সে উদ্যানটাকে উপভোগ করবে এবং সে ভাববে এটি আমার। কিন্তু এমনটি এখন আমরা পাচ্ছি কি?
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে আগের সেই সোনালী দিন আর নেই। অনেকেই আছেন তিনি শেষ কবে সিনেমা হলে গিয়েছিলেন তা হিসেব করে বলতে পারবেন না। কেউ কেউ আছে কালেভদ্রে যাচ্ছেন আবার ফিরছেন হতাশ হয়ে। বলা চলে হল-বিমুখ মানুষ। যার ফলে অনেক হল বন্ধের নেপথ্য।
এর কারণ কি? একবাক্যেই সকলে বলবেন চলচ্চিত্রে মান নেই। তাই যাচ্ছি না। যাচ্ছে না। তাহলে কি সিনেমা তৈরি হচ্ছে না! হচ্ছে। অনেক অনেক ছবিই নির্মাণ হচ্ছে। যে সমস্ত ছবির মান একদম তলানিতে। মানে নকলের কারণে নাকাল দর্শক অনেকটাই হল-বিমুখ।
দেখা যাচ্ছে, সংলাপ, গান, নাচের মুদ্রা, পোশাক, দৃশ্যায়ণ তথা পুরো গল্প এবং চিত্রনাট্যটাই এক বা একাধিক সিনেমা থেকে কপি করে নেয়া।
উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়-এর একটি টিভি সাক্ষাৎকার দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। সেখানে উপস্থাপক তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন-‘নকল করাটাকে আপনি কোন চোখে দেখেন’?
সত্যজিৎ রায় স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববর্তীকে উত্তরবর্তী নকল করবে এটা স্বাভাবিক। তবে অবশ্যই পূর্ববর্তীর থেকে ভালো উপস্থাপনাটা উত্তরবর্তীকে করতে হবে। তা নাহলে নন্দিত হওয়ার বদলে নিন্দিত হবে-এটাও স্বাভাবিক’।
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি অনুকরণ বা নকল করা মন্দ না। কিন্তু ভালো করতে হবে। অর্থাৎ যাকে নকল বা অনুকরণ করব তার থেকে ভালো করতেই হবে। আমরা কি সেটা করতে পারছি? নাকি নকল করে ঘৃণিত হচ্ছি?
তবে আমরা কেনো এমন করছি! কেনো করছেন এসব চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা? কেনো অন্যদের গল্প নকল করে ছবি বানাতে হবে? কেনো তাদের চিত্রনাট্য নকল করতে হবে! এসব কি আমরা তৈরি করতে পারি না?
অবশ্যই পারি। সে যোগ্যতা আর দক্ষতা আমাদের আছে। কিন্তু প্রয়োগের পর্যাপ্ত পরিমাণের সুযোগ নেই। যারা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট তথা প্রযোজক রয়েছেন তারা সে সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছেন না। এরা নির্দিষ্ট কয়েক জনের উপরই নির্ভর।
দেখা যাচ্ছে এমন একজন চিত্রনাট্য লিখছেন, যিনি এক মাসে তিন চারটি চিত্রনাট্য লিখছেন! আবার দেখা যাচ্ছে কেউ বলছেন সিনেমা বানাবেন। এরপর এক কি দুই মাসের মধ্যেই সেই সিনেমা মুক্তিও পেয়ে যায়! এরমধ্যেই গল্প লেখা ও চিত্রনাট্য তৈরি থেকে শুরু করে করে শুটিং, এডিটিং সেন্সর সব শেষ! এটাও সম্ভব!
হুমম, সম্ভব। এমনটাই হচ্ছে। যার কারণে আমরা মানহীন সিনেমা পাচ্ছি, আশ্রয় নিতে হচ্ছে নকলের উপর। ফলে বারবারই হতাশ হচ্ছেন দর্শকক।
তবে কথা হচ্ছে ভালো সিনেমা তথা মৌলিক গল্পের সিনেমা কি আমাদের দেশে হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। যা আমার কাছে ব্যতিক্রম, উদাহরণ নয়।
একটা মজার অভিজ্ঞতা বলি, বেশ ক’বছর আগে জৈনক ব্যক্তিকে আমি বলেছিলাম আমাকে চিত্রনাট্যের কাজ দিয়েন। এরপর কিছুদিন পর তিনি আমাকে একটি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে বলেছিলেন।
আমি তো খুশিতে গদগদ। ভদ্রলোক পাঁচটি হিন্দি সিনেমার সিডি তুলে দেন আমার হাতে। জানতে চাইলাম কেনা? তিনি বললেন, একটি থেকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আরেকটার থেকে প্রেম, অন্যটির থেকে কমেডি, আরেকটার থেকে ভিলেনর ভাব ভঙ্গিমা একত্রিত করে চিত্রনাট্য বানান। আমি পুরাই টাস্কি! কয় কি? আমি সন্তানের বাবা হব আর সে সন্তান আমার ব্রুণের না! ভাই স্যরি।
এরপর অনেকদিন অ-মুখো হাঁটিনি। তবে সিনেমা বানাব। এটা আমার নেশা। সেই নেশা থেকেই ‘লাইটার’, ভার্চুয়াল’, ‘কাঁটাতার’ এবং ‘নিলু ও রূপকের গল্প’ শিরোনামে সিনেমার গল্প তৈরিসহ চিত্রনাট্য (বহুলাংশ) তৈরি করছি।
এসময় আশি দশকের একজন নায়ক আমাকে তার এক পরিচিত প্রযোজকের কাছে পাঠালেন। তার মতে তিনি খুব ক্রিয়েটিভ। আমার কাজগুলো তা পছন্দ হবে। গেলাম বাংলা মোটরে।
এই ভদ্রলোকের কথা শোনে আমি একদমই বেকুব বনে গেলাম। তার কথাগুলো ছিলো, ভাই আমার সিনেমাতে মালেয়শিয়া, ব্যাংকক, রাঙামাটিসহ কিছু লোকেশন থাকতে হবে। হেলিকপ্টারের দৃশ্য থাকতে হবে!
সরাসরি বলতে না পারলেও মনে মনে আমি বললাম-আরে ভাই, ওইসব মালেয়শিয়া, ব্যাংক, হেলিকপ্টারের প্রোয়জনে কি গল্প হবে! নাকি গল্পের প্রয়োজনে ওসব আসলে আসবে? কি আর করার নিরাশ হওয়া ছাড়া কি আর করা?
এতে করে অন্তত বুঝতে পারলাম, কেনো আমাদের চলচ্চিত্রের মান ফিরে আসছে না। কেনো আমাদের নিজস্ব গল্পে ছবি হচ্ছে না। কেনো এত নকলের ছড়াছড়ি। এর পিছনে দায় কারা।
তবে পরিশেষে একটা কথাই বলছি, আবারো বাংলা সিনেমায় সোনালী সেই দিন ফিরবে। যান্ত্রিক জীবনে একটু বিনোদিত হতে মানুষ আবারও হল-মুখো হবে। লেখক : কবি ও সাংবাদিক
২০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি
�