নারায়ণগঞ্জের পীযূষ কলকাতার বড় অভিনেতা
বিনোদন ডেস্ক : ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। পরে অবশ্য পাকাপাকিভাবে বসবাস করতেন কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যোগ দেন ব্যাংকে। কিন্তু অভিনয় প্রেম তাকে সেই চাকরিতে বেশিদিন টিকতে দেয়নি।
অভিনয়কে ভালোবেসে ব্যাংকের চাকরিটা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। যে মানুষ স্বপ্ন দেখে, যে মানুষ গান করে, যিনি রক্ত দিয়ে ভালোবাসেন অভিনয়, তিনি কী করে বাঁধা থাকবেন চাকরির চেনা গণ্ডিতে। থাকেনওনি। সবকিছুকে বিদায় দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন অভিনেতা জীবনকে। মঞ্চের আলো আঁধারিতে সেই জীবনকে মূর্ত করে তোলার জীবনই যাপন করে চলেন আজীবন। থিয়েটারের শক্তিমান এই অভিনেতা কাজ করেছেন বাংলা নাটকের বহু বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে। বিভাস চক্রবর্তী থেকে ব্রাত্য বসু- বিভিন্ন সময়ে নাট্য পরিচালকদের সহায় হয়েছে তাঁর কুশলী অভিনয় প্রতিভা। ‘মাধব মালঞ্চ কইন্যা’, ‘জোছনা কুমারী’, ‘আকরিক’, ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র’ থেকে ‘ব্রেন’, ‘সিনেমার মতো’ বাংলা নাট্যদুনিয়ার সেরা নাটকগুলিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’ নাটকে গ্যালিলিওকে নতুন করে রূপও দিয়েছিলেন।
শম্ভু মিত্র, কুমার রায়ের মতো তাবড় অভিনেতারা বাংলার মঞ্চে যে চরিত্রের রূপদান করেছেন, সেটিকেই একেবারে নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেন স্বকীয় মেজাজে। গ্যালিলিওর দ্বন্দ্ব, শিল্প ও সত্তার সংঘাতের সঙ্গে কী অনবদ্য অভিনয় দক্ষতায় তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন একজন সাধারণ চেনা মানুষকে মানসিক টানাপোড়েনের বাস্তবোচিত ব্যবহারগুলিকে। ফলত এ গ্যালিলিও গা চুলকোয়, দাঁত খোঁটে। এমনকী খেয়েদেয়ে ঢেঁকুরও তোলে। কোথাও কোনও আরোপ নেই। বিস্ময়াবিষ্ট দর্শক শুধু দেখেছেন, সাধারণের এই সাজে কীভাবে প্রতি পলে অসাধারণ হয়ে উঠতেন পীযূষ। সে অভিনয় বন্ধ হয়ে গেল চিরকালের জন্য। আবারও পড়বে থার্ড বেল, উঠবে মঞ্চের পর্দা, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় আর কোনোদিন এসে দাঁড়াবেন না সেন্টার স্টেজে।
বাংলা সিনেমা ও টেলিভিশনের দুনিয়াতেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ। বাংলা টেলিসিরিয়ালের আদিপর্ব থেকেই তিনি ছিলেন এই মাধ্যমে সক্রিয়। ‘জন্মভূমি’, ‘সোনার হরিণ’র মতো সিরিয়াল থেকে ফিলহাল ‘জল নুপূর’ বা ‘চোখের তারা তুই’ সিরিয়ালেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি কাজ করে গিয়েছেন বাংলা ছবিতেও। চিদানন্দ দাশগুপ্তর ‘আমোদীনি’ থেকে অপর্ণা সেনের ‘গয়নার বাক্স’, অঞ্জন দত্তর ‘ম্যাডলি বাঙালি’ থেকে সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’ স্ক্রিনে পীযূষ গঙ্গোপাধ্যয় আসা মানেই কী অনায়াসে এক একটি চরিত্র হয়ে ওঠা। আরো কাজ করেছেন যার ‘বাবা কেন চাকর’, ‘ইতি শ্রীকান্ত’, ‘ব্যোমকেশ বক্সি’, ‘আবার ব্যোমকেশ’, ‘আবর্ত’ ছবিতে। ২০০৫ সালে ‘মহুলবনীর সেরেঙ’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়।
নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেই হরেক চরিত্রাভিনয়ের এরকম এক দক্ষ অভিনেতাকে আর পাবে না বাংলা সিনেমার দুনিয়া। এমনকী অসংখ্য টেলিফিল্মে তিনি যে অভিনয় রেখে গেলেন তাও আগামী প্রজন্মের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।
গানও গাইতে পারতেন চমৎকার। টেলিভিশনের পর্দাতেই অ্যান্টনি কবিয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করে, গেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন দর্শকদের। নাটকে যেমন গাইতেন, তেমন প্লে-ব্যাকও করেছেন। রেকর্ডে ধরা থাকলো সে সব। আর কখনও ‘লাইভ’ হবেন না পীযূষ।
এই অভিনেতা ভালো ফুটবলও খেলতেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তাকে বহুবার আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে যে, দুর্ঘটনায় না পড়লে গোলকিপার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তেন। বেহালা ইয়ুথে খেলেছেন তিনি।
গত মঙ্গলবার বিকেলে সাঁতরাগাছি ব্রিজের উপর বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় তার গাড়ির। পরে তাকে ভর্তি করা হয় বেলভিউ নার্সিংহোমে। একই গাড়িতে ছিলেন নৃত্যশিল্পী মালবিকা সেন। তিনিও গুরুতর জখম হন। প্ল্যাস্টিক সার্জারির পর তিনি আপাতত সুস্থ।
তবে সারা শরীরে গভীর ক্ষত, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া পাঁজর, ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া হাত-পা। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শুক্রবার তাকে নেয়া হয় নিবির পরিচর্যা কেন্দ্রে। বিপজ্জনকভাবে কমছিল রক্তচাপ আর পালস রেট। সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। রক্তে মিশছিল ফ্যাট। তার জেরে মাল্টি অর্গান ফেলইয়োর। ধাপে ধাপে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার হয় পীযূষের। কিন্তু ক্রমশ তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ। পঞ্চাশ বছরে থেমে গেলো এ গুণী অভিনেতার জীবন। পীযূষ ও স্ত্রী পামেলা গঙ্গোপাধ্যায়ের এক ছেলে রয়েছে। -বাংলামেইল
২৫ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন
�