জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত যে তারকারা
আলাউদ্দীন মাজিদ : প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান ৫০টিরও বেশি ছবি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে অশিক্ষিত ও ছুটির ঘণ্টার মতো কালজয়ী ছবির জন্য তিনি পাননি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জাতীয় পুরস্কার হলো কাজের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। এই পুরস্কার পেলে উৎসাহ বাড়ে। কাজে গতি আসে। না পেলে অবশ্যই হতাশা মনে বাসা বাঁধে। অভিমানী হন অনেকে। জাতীয় পুরস্কার বঞ্চিত এমন অভিমানী চলচ্চিত্রকারের সংখ্যা অনেক।
বলিষ্ঠ অভিনেতা ফারুককে তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মাত্র একবার জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাও আবার পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’ ছবির জন্য তাকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফারুক বলেন, আমি আসলে দলীয় প্রতিহিংসার শিকার। ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’সহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করে আকাশছোঁয়া দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছি।
চলচ্চিত্রবোদ্ধারা আমার অভিনয়ের প্রশংসাও করেছেন। আশা ছিল সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পাব। কিন্তু হতবাক হয়েছি। আসলে আমি অভিনয়ে আসার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে অন্য দলীয় সরকারের আমলে আমাকে এই পুরস্কার থেকে ইচ্ছা করেই বঞ্চিত করা হয়েছে।
অভিনেতা ফারুকের মতো আক্ষেপ প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলমেরও। প্রায় চার দশক ধরে চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তার গানের জনপ্রিয়তা সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। চলচ্চিত্রে প্রায় পাঁচশত গান করেছেন তিনি। যার মধ্যে ৯৮ ভাগই শ্রোতাপ্রিয়। অথচ এই জনপ্রিয় শিল্পী আজ পর্যন্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি।
অভিমান করে তিনি বলেন, আমাকে যেন কখনো কোনো সরকার মরণোত্তর পুরস্কার না দেয়। বেঁচে থাকতে যখন কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পেলাম না তখন মরার পর এই পুরস্কার পেয়ে লাভ কী? পরিবারের সদস্যদের বলেছি, আমার মৃত্যুর পর এই পুরস্কার দিলে তারা যেন তা প্রত্যাখ্যান করে। আরেক কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারও পাননি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
অভিনেত্রী রানী সরকার একজন তুখোড় অভিনেত্রী। প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনয়ের কথা এখনো ভুলতে পারেনি দর্শক। অথচ তাকে কখনো জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এই অভিনেত্রী আক্ষেপ করে বলেন, চলচ্চিত্রে অভিনয় করে কী পেলাম। নির্মাতারা ঠিকমতো পারিশ্রমিক দিত না। সরকার আমার কাজের মূল্যায়ন কখনো করেনি। আর এখন আমাকে দেওয়া হয় দুস্থ শিল্পীর অনুদান। নিজের প্রতি ঘেন্না হয়। কেন অভিনয়ে এলাম। তার চেয়ে ঝাড়–দার হলে এখনো খেয়ে-পরে বাঁচতে পারতাম। শেষ বয়সে এসে কারও কাছে হাত পাততে হতো না।
রানী সরকারের মতো পুরস্কার দেওয়া হয়নি রহিমা খালা, মায়া হাজারিকা, সুমিতা দেবী, মিনু রহমান, মিনারা জামান, রিনা খানসহ অনেককে।
প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ নিজ নামেই জনপ্রিয়। ছবিতে তার উপস্থিতি মানে দর্শকক্রেজ। তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবিতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কার জোটেনি তার কপালে। তার কথায় ‘দর্শকের ভালোবাসাই আমার প্রধান পুরস্কার। ভালো অভিনয় করা সত্তে¡ও কেন জাতীয় পুরস্কার পাইনি তা আমার জানার কথা নয়। আমি তো পুরস্কারের জন্য অভিনয় করি না। এমন আক্ষেপ নিয়ে মারা গেছেন কৌতুক অভিনেতা আশীষ কুমার লৌহ, হাসমত, খান জয়নুল, রবিউল, বেবী জামানসহ অনেকে।
প্রখ্যাত অভিনেত্রী শবনম ১৩ বার নিগার ও ৩ বার পাকিস্তানের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও পাননি বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার। অথচ প্রায় এক ডজন বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে আশির দশকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ও নব্বই দশকে নির্মিত কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তাকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। তাদের কথায়, গুণীর গুণের মূল্যায়ন না করলে ভালো শিল্পী তৈরি হবে না।
আরেক ডাকসাইটে অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন শিল্পী। অনেকের কথায় তাকে কমপক্ষে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবির জন্য পুরস্কার দেওয়া দরকার ছিল। সুজাতার মতো রূপবান কন্যা খ্যাত দক্ষ অভিনেত্রীও পাননি জাতীয় সম্মান। জাতীয় পুরস্কার না পাওয়া এমন নায়িকার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এদের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন অপু বিশ্বাস। ‘দেবদাস’ ছবিতে পার্বতী অর্থাৎ মুখ্য ভ‚মিকায় অভিনয় করেও তিনি পাননি এই পুরস্কার। অথচ তার অভিনয়ের প্রশংসা করে খোদ এই ছবির নির্মাতা প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম তার জীবদ্দশায় বলেছিলেন, দেবদাস ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেরা পুরস্কার অপুর প্রাপ্য।
অভিনেতাদের মধ্যে ফারুকের পাশাপাশি জসীম, ওয়াসিম, জাভেদসহ অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে।
১৯৮৭ সালে জসীম ‘সারেন্ডার’ ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। তার ভক্তরা ধরেই নিয়েছিলেন ওই বছরের জাতীয় পুরস্কার জসীমের ঘরেই আসছে। কিন্তু সেই ভাগ্য আর এই অভিনেতার হয়নি। এক সময়ের খল-অভিনেতা হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ইনাম আহমেদ। এ দেশের প্রথম বাংলা ছবি ‘মুখ মুখোশের’ নাম ভ‚মিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি।
তার ভাগ্যেও জুটেনি জাতীয় পুরস্কার। আরেক খ্যাতিমান খল-অভিনেতা আবদুল মতিনও জাতীয় পুরস্কার থেকে অধরা থেকে যান। খল চরিত্রে অভিনয় করে দক্ষতা দেখানো এমন জাতীয় পুরস্কার বঞ্চিত শিল্পীর তালিকাও নেহায়েত ছোট নয়। রাজ, আদিল কিংবা দারাশিকোর কথা এ দেশের দর্শক কখনো ভুলবে না। তাদের ঘরেও কখনো উঠেনি জাতীয় পুরস্কারের ট্রফি।
ঢাকার চলচ্চিত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সুজন সখী, দিন যায় কথা থাকেসহ অনেক অসাধারণ ছবির বলিষ্ঠ নির্মাতা খান আতাউর রহমানের মতো ব্যক্তিত্বও কখনো পাননি পরিচালক বা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। যদিও চিত্রনাট্যকারের সম্মান তিনি পেয়েছেন। আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা কাজী জহির। যিনি ময়নামতি, অবুঝ মন, বধূ বিদায়, মধু মিলনের মতো জনপ্রিয় সব ছবি নির্মাণ করে বাংলা চলচ্চিত্রের আদর্শ নির্মাতা হয়ে আছেন তিনিও কখনো পাননি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের দেখা।
সালমান শাহর মতো একজন অসাধারণ অভিনেতা আর কখনো ঢাকার চলচ্চিত্রে আসবে না। অভিনয়ের মাত্র চার বছরে দুই ডজনেরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। স্বল্প সময়ে তার মতো এমন অভিনয় দক্ষতা আর জনপ্রিয়তা অন্য কোনো নায়কের ভাগ্যে জুটেনি। অথচ তিনিও জাতীয় পুরস্কারে রয়ে গেলেন অধরা। ঢাকার ছবির আরেক স্টাইলিশ নায়ক খ্যাত জাফর ইকবাল। তার অভিনয় স্টাইল ছিল তরুণ দর্শকদের কাছে রীতিমতো অনুকরণীয়। এ সত্তে¡ও জাতীয় পুরস্কারের মন জয় করতে পারেননি তিনি।
ঢাকার চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অঙ্গনে এমন জাতীয় পুরস্কারে অধরা থেকে যাওয়া অগণিত তারকা রয়েছেন। এদের মধ্যে সংগীত পরিচালক থেকে শুরু করে মেকআপ ম্যান, ক্যামেরাম্যান, সম্পাদক, শিল্প নির্দেশক, শিশু শিল্পীও রয়েছেন। আগামীতে আরেক কিস্তিতে তাদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরা হবে। -বিডি প্রতিদিন
৩ নভেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস
�