শুক্রবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৮:৪১:৩৫

তেহারি আছে, সেই স্বাদ নেই, বললেন এটিএম

তেহারি আছে, সেই স্বাদ নেই, বললেন এটিএম

মেহেদী হাসান: খাবারের বেলায় বাঙালিয়ানাই তাঁর কাছে প্রথম ও শেষ কথা। কারণ নিজেকে মনে করেন ‘সর্বান্তকরণে বাঙালি’। তিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। তাঁর বাড়ির হেঁশেলের সব রান্না হয় সাদা ভাতকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন, ‘আমি টাকি মাছের ভর্তা খাই, কালিজিরার ভর্তা খাই, চ্যাপা শুঁটকি দিয়ে বেগুন খাই। এগুলো আমার পছন্দের খাবার। সব ধরনের মাংস আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি।’ আর কী? ‘সবজি’-এক শব্দে উত্তর। আর? একটু যেন ভাবতে শুরু করলেন। এভাবেই বর্ণিল খাবারদাবারের কাছে খাবার নিয়ে গল্পের ঝাঁপি খুললেন শক্তিমান এই অভিনেতা।

সরিষার তেলের তেহারি
এ টি এম শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯৪১ সালে, নোয়াখালীর দৌলতপুরের নানাবাড়িতে। বাবা ছিলেন নামকরা উকিল। বাবার কর্মসূত্রে জন্মের ৪০ দিন পর সপরিবার তাঁরা ঢাকায় আসেন। পরের ৭৬ বছর ধরে তিনি ঢাকায়। নির্দিষ্ট করে বললে পুরান ঢাকায়। এই সময়টাতে ঢাকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। তবে তিনি বলেন, ‘সেই খাবার আছে, শুধু সেই স্বাদ নেই।’
যখন ছোট ছিলেন, তখন পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে দুটি খাবার খুব জনপ্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করেন। একটা হলো সকালবেলায় মাঠা-মাখন। একদম খালি পেটে। এরপরেই খাওয়া হতো তেহারি। এই হলো সকালের নাশতা। ‘তবে সেই তেহারি আর এখন নেই। এখন যেটা আছে, সেটা হলো বিরিয়ানির সংস্করণ,’ বলেন এ টি এম শামসুজ্জামান। তেহারির একাল-সেকালের মধ্যে ঠিক কী এমন পরিষ্কার দাগ টেনে দিল? তাঁর উত্তর, তখন তেহারি রান্না হতো সরিষার তেল দিয়ে।

আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়
এ টি এম শামসুজ্জামানের সঙ্গে কথা হলো গত ৩০ জুলাই। ঢাকার সূত্রাপুরের তাঁর বাড়িতে। অভিনয় নয়, আমাদের জানার বিষয় তাঁর খাবারদাবার নিয়ে। খুব অবাক হলেন তিনি। তবে যখন বলতে শুরু করলেন, সে গল্পের ডালপালা ছড়িয়ে পড়ল দেশ থেকে বিদেশে, বর্তমান থেকে ষাটের দশকের সুদূর অতীতে। তবে বেশির ভাগজুড়ে ছিলেন মা নুরুন্নেসা বেগম।

এ টি এম শামসুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকায় আগে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। নদীর মাছ। এর মধ্যে ভাগ হিসেবে বিক্রি হওয়া পাঁচমিশালি মাছের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। এই মাছ সব ধরনের মসলা দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে মা মাটির ভাঙা হাঁড়িতে রান্না করতেন। যখন এই কলাপাতার মোড়ক খোলা হতো, তখন যে সুবাস ছড়াত, তাতে শুধু সুবাস দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলা যেত। আমার বাবা দেশি বড় বড় কই আনতেন, এটা আমার খুব পছন্দের ছিল। কদু (লাউ) দিয়ে শোল মাছ রান্না করতেন আমার মা। সেটাও আমার খুব পছন্দের ছিল।’

এ টি এম শামসুজ্জামানের মা সরপুঁটি রান্না করতেন। সেই সরপুঁটি নাকি এখন আর পাওয়া যায় না। বলেন, ‘একটা প্রবাদ আছে, “আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়”। আশ্বিনের শেষ দিন বিকেলবেলা মা সরপুঁটি রান্না করে রাখতেন। পরদিন কার্তিকের সকালে আমরা কাঁচা পেঁয়াজ আর সর জমা সরপুঁটি দিয়ে পান্তাভাত খেতাম।’
তাঁর মা নারকেল দিয়ে মুরগি রাঁধতেন। প্রথমে নারকেল কোরাতেন। এরপর সে কোরানো নারকেল পাটায় বাটতেন। সেই নারকেল রান্না করতেন মুরগি দিয়ে। ‘মা মারা গেলেন, সেই রান্নাও আর হয় না। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম, সে রকম আর হয় না।’

নিজের মায়ের সম্পর্কে এ টি এম শামসুজ্জামান বলেন, ‘আমার মা অনেক রকমের রান্না জানতেন। বৈশাখের মাঝামাঝি কাঁচা আম পাওয়া যেত। মা খুব পরিশ্রমী ছিলেন। সারা দিন ধরে তিনি কাঁটা চামচ দিয়ে এই আমের টক ঝরাতেন। এরপর চিনির সিরায় রেখে কাঁচা আমের মোরব্বা বানাতেন। এরপর এটা রেখে দেওয়া হতো। দুধ দিয়ে এই মোরব্বা খাওয়া হতো। মা নেই, সেই মোরব্বাও নেই।’

কোরবানির ঈদে বড়জোর এক টুকরা মাংস
মাংস একেবারেই পছন্দ না এ টি এম শামসুজ্জামানের। কোনো মাংসই না। তবে ঈদ এলে এক টুকরা মুখে দেন। এর বেশি কিছু না। তাঁর মা ঈদে পোলাও রান্না করতেন। পোলাওর ওপর জাফরান ছিটিয়ে দিতেন, সঙ্গে দিতেন কেওড়ার জল। এতে আশপাশের দশ বাড়ি পর্যন্ত এই পোলাওর সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। এর সঙ্গে আরও রান্না হতো খাসির রেজালা। একটা ঝাল, একটা মিষ্টি।
জুতার প্রতি শামসুজ্জামানের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। ঈদে জামা না হলেও চলত, কিন্তু নতুন জুতা না হলে ঈদ অপূর্ণ থেকে যেত। বায়না ধরে বাবার কাছ থেকে নতুন জুতা আদায় করতেন। এমন কোনো খাবার আছে, যা খাওয়ার জন্য এমন বায়না ধরতেন শামসুজ্জামান? উত্তরে বলেন, ‘না। কারণ আমার মা এত চমৎকার রান্না করতেন যে খাবার নিয়ে আমার বিশেষ কোনো দুর্বলতা ছিল না।’

প্রবাসে নিজের হাতে রান্না
গরুর মাংসের প্রতি তাঁর চিরকালের অনীহা।এখনো কালেভদ্রে এক-দুই টুকরা বাদ দিলে খাওয়া হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে যখন যেতেন, গরুর মাংস কিনতেন, নিজেই রান্না করে খেতেন। অন্য মাংস কেনার সুযোগ ছিল না। সকালে পান্তাভাত, বড় বড় করে কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে আগের রাতে রান্না করা গরুর মাংস দিয়ে সকালের নাশতা সারতেন।
প্রথম চীনা খাবার
ষাটের দশক। ঢাকায় প্রথম চীনা খাবারের রেস্তোরাঁ চালু হলো। নাম ‘চৌ চিন চাও’। সে সময়ের ঘটনা উল্লেখ করেন এ টি এম শামসুজ্জামান। বললেন, ‘প্রথমে স্যুপ খেলাম। ভালো। এরপর মূল খাবার। কেমন আটা আটা, কাঁচা কাঁচা। তা-ও খেলাম। এরপর বাটিতে কুসুম গরম পানি দিয়ে গেল, সঙ্গে লেবু। লেবু চিপে নিয়ে একটু লবণ মিশিয়ে সে পানিও খেয়ে ফেললাম। খানিক পরে ওয়েটার এসে বলল, পানি কই? আমি বললাম, খেয়ে ফেলেছি। পরে জানলাম ওই পানি দিয়েছিল হাত ধোয়ার জন্য। জীবনে সেই প্রথম চীনা খাবার খাওয়া। পাঁচজনের খাবারে বিল এসেছিল এক টাকা চার আনা।’

এক রুপির আহার
বছর বিশেক আগে শুটিংয়ের কাজে গিয়েছিলেন ভারতে। ছিলেন মাদ্রাজ শহরে। গন্তব্য হগেনাকাল। দীর্ঘ পথ। রাস্তার দুধারে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তেঁতুলগাছ। সেটুকু বাদ দিলে ফাঁকা এলাকা। এমন সময় পেল খিদে। সঙ্গে থাকা গাইডকে বলেন কোনো ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে। কিন্তু যে রেস্তোরাঁ তাঁরা পেলেন, তার অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। আশপাশে দু-চার-দশ মাইলে আর কিছু নেই বলেও জানানো হলো। খিদেও পেয়েছে। অগত্যা সেখানেই ঢুকলেন। প্রথমে বাসনের বিকল্প হিসেবে এল কলাপাতা। এরপর এল ভাত, বালতিতে করে। এরপর দু-চামচ ঘি এনে ছিটিয়ে দিল ভাতের ওপর। এরপর এল সবজি, তা-ও বালতিতে করে। দেখেই তাঁর মোটামুটি নাক সিটকানো অবস্থা। এরপর এল ডাল। খাওয়া শেষে দেওয়া হলো এক গ্লাস তেঁতুলের শরবত। শামসুজ্জামান বলেন, ‘আমি আমার জীবনে অনেক দেশের অনেক সুস্বাদু খাবার খেয়েছি। কিন্তু সবজির এমন স্বাদ আর কোথাও পাইনি। বিল দিতে গেলাম। বলে এক রুপি বিশ পয়সা!’

ভিনদেশে প্রেম
শুটিংয়ের জন্য ঘুরেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সে সূত্রেই গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে। সেখান থেকে নুয়ারা এলিয়া। কলম্বোতে প্রচণ্ড গরম। নুয়ারা এলিয়ায় ঠিক উল্টো। প্রথম রাতটা কোনোমতে হিটার জ্বালিয়ে কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সকালে অপরূপ এক মেয়ে তাঁর সকালের চা নিয়ে এল। এ টি এম শামসুজ্জামান দেখেই বললেন, ‘তুমি খুব সুন্দর।’ এক শব্দে উত্তর এল, ধন্যবাদ। এরপর নিজের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বললেন সে মেয়েটিকে। যে কয়েকটি দিন সেখানে ছিলেন শামসুজ্জামান, সেই মেয়েটি স্বজনের মতো তাঁর খাবারদাবারের খেয়াল রেখেছিল। কোনো ধরনের মাংস ছুঁয়ে দেখতেও দেয়নি। মেয়েটির এমন আতিথেয়তায় সবার মনে সন্দেহ ঢুকে যায়, তাঁদের মধ্যে প্রেম চলছে কি না। দেশে ফিরে সেই মেয়েটির চিঠিও পেয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিল কেমন আছেন তিনি, কেমন লেগেছে তাকে, কেমন লেগেছে তার দেশ।-প্রথম আলো
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে