রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:০৭:০৬

আহারে মুভি, আহা মুভি; ডুব গেল নিজেই ডুবি!

আহারে মুভি, আহা মুভি; ডুব গেল নিজেই ডুবি!

আখতারুজ্জামান আজাদ : মনে করি, 'ডুব' টেলিফিল্মটি জীবিত বা মৃত কারো জীবন বা মৃত্যু নিয়ে নির্মিত নয় এবং ডুবের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। এমনটি ধরে নিয়ে ডুব দেখতে বসা যাক। একশো চার মিনিটে ডুবে চারটি প্রধান চরিত্র দেখা যাবে।

এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার, যার ঘরে একজন স্ত্রী ও দুজন সন্তান আছে। নির্মাতাটি তার তৎকালীন ষোড়শী প্রেমিকাকে এককালে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন এবং বর্তমানে সেই স্ত্রীকে নিয়ে অসুখী। একপর্যায়ে তিনি তার কন্যার স্কুলবান্ধবীকে নিয়ে বসবাস বা সহবাস করা শুরু করেন এবং একদিন হঠাৎ করে মারা যান।

মরদেহ দ্বিতীয় স্ত্রীর পছন্দমতো জায়গায় দাফন হওয়া নিয়ে নির্মাতার কন্যা মন খারাপ করে চাচার সাথে সজোরে চিৎকার করেন এবং কফিন ধরে কিছুক্ষণ বিলাপ করেন। টেলিফিল্মটি এখানেই শেষ। পাপুয়া নিউ গিনি, প্যারাগুয়ে, হাইতি কিংবা হন্ডুরাসের কোনো দর্শক এই টেলিফিল্মটি দেখলে গল্পে নিশ্চয়ই নতুনত্বের নয়াদিগন্ত উন্মোচন করতে পারবেন, তার কাছে গল্পটি মনে হবে একদমই অচেনা।

টেলিফিল্মটির শুরুর দৃশ্যে একটি বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীর পশ্চাৎমঞ্চ দেখানো হয়, যেখানে বসে থাকেন বিদ্যালয়ের সাবেক দুই তারকা ছাত্রী— তিশা ও পার্নো। তারা দুজন নির্বাক বসে থাকবেন এবং গোটা টেলিফিল্মটি দেখানো হবে ফ্লাশব্যাকে।

সেই ফ্লাশব্যাকের মধ্যে আবার ফ্লাশব্যাক থাকবে, সেই ফ্লাশব্যাকের মধ্যে আবার ফ্লাশব্যাক থাকবে, সেই ফ্লাশব্যাকের মধ্যে আবার ফ্লাশব্যাক থাকবে এবং কোনটা ফ্লাশব্যাক আর কোনটা বর্তমানকালের ঘটনা— তা বুঝতে গেলে মাথায় ক্ল্যাশ ঘটবে। এর এক দৃশ্যের সাথে পরবর্তী দৃশ্যের সহসা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ডুব টেলিফিল্মের অধিকাংশ দৃশ্য নিশ্চিত ড্র হতে যাওয়া পাঁচদিনের টেস্টের মতো দীর্ঘ ও নিরুত্তাপ, জাভেদ ওমর বেলিমের ব্যাটিংয়ের মতো ধীর ও নিদ্রা-উদ্দীপক। এখানকার কোনো চরিত্র যখন চা পান করেছে, তখন প্রায় পুরো কাপ শেষ করার পর ক্যামেরা সরেছে, এই ফাঁকে সে চা পান করেছে-করেছে-করেছে-করেছে-করেছে; কোনো চরিত্র যখন ধূমপান করেছে, তখন ক্যামেরা সরেছে প্রায় পুরো সিগ্রেটটি শেষ হওয়ার পর, এই ফাঁকে সে সিগ্রেট খেয়েছে-খেয়েছে-খেয়েছে-খেয়েছে-খেয়েছে।

আবার কেউ যখন হেঁটেছে, তখন মনে হয়েছে ম্যারাথন না জিতে এই চরিত্রটি থামবে না; কেউ যখন আধ্যাত্মিক উপদেশ দিতে শুরু করেছে, তখন মনে হয়েছে শিষ্যটিকে নির্বাণ লাভ না করিয়ে এই গুরুটি ছাড়বেন না। টেলিফিল্মটিতে ব্যাপক পরিমাণে রাস্তাঘাট, দেয়াল, মেঝে, সিলিং, সিঁড়ি, জানালা, ফুল-ফল, লতা-পাতা, সাগর, নদী ও বান্দরবানের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে সময় পার করা হয়েছে।

এর একটা বড় অংশ কেটে গেছে কথাবার্তা ছাড়াই, এ যেন একুশ শতকের নির্বাক চলচ্চিত্র। কেউ কোনো কথা বলছে না, তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে অথবা ফোলা-ফোলা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে— এভাবেই কেটে গেছে ডুবের বিরাট অংশ। উচ্চারিত সংলাপগুলোর একটা বড় অংশ অস্পষ্ট।

অবাঙালি অভিনেতাকে দিয়ে বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করাতে না পেরে পরিচালক তাকে দিয়ে অধিকাংশ সংলাপ ইংরেজিতে বলিয়েছেন এবং গোটা টেলিফিল্মে ইরফান খানের এমন কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না, যা দেখে মনে হতে পারে তিনি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা কিংবা যা দেখে মনে হতে পারে তার পেশা কী। নিষ্প্রাণ-নির্জীব একেকটি চরিত্রকে টেলিফিল্মের শুরু থেকে মনে হয়েছে জীবিত লাশ।

গল্পের মূল চরিত্র ইরফান খানের সাথে পার্নোর ঘনিষ্ঠতা কীভাবে হলো, তারা কেন পরস্পরকে পছন্দ করলেন, পরে কেন দ্বন্দ্ব হলো, শেষে ইরফান কেন কী দুঃখে মারা গেলেন; টেলিফিল্মে তা স্পষ্ট না। পার্নোকে তিনি আদৌ বিয়ে করেছেন কি না, নাকি তারা দুজন লিভটুগেদার করছেন— তাও স্পষ্ট না। প্রথম স্ত্রী রোকেয়া প্রাচীকে তালাক দিয়ে পার্নোর সাথে সহবাস করে কেন তিনি পার্নোকে নিয়েও সুখী হননি, কেন ও কী নিয়ে তিনি পার্নোর সাথে ঝগড়াঝাটি করেছেন, টেলিফিল্মটিতে স্পষ্ট না তা-ও।

অর্থাৎ চরিত্রগুলোর পরিচয় কী, তারা কেন এত অসুখী, কেন প্রতিটি চরিত্র আধাভৌতিক; এই টেলিফিল্ম দেখে এসবের কিছুই ঠাহর করা যাবে না। বাবার লুঙ্গি থেকে কেটে নেওয়া একাংশ, চাচার স্যান্ডো গেঞ্জি থেকে ছিঁড়ে নেওয়া কিয়দংশ, দাদির গামছা থেকে ফেঁড়ে নেওয়া ভগ্নাংশ এবং দাদার পরিত্যাক্ত পাজামার অংশবিশেষের সমন্বয়ে নাতির জন্য বানানো বিচিত্র পোশাকের মতো মনে হবে ডুবকে। ডুবের পরিচালক এ রকম একটি পোশাক বানিয়ে 'পারলে বুইঝা ল পোশাকের কোন অংশ কার ছিল' মর্মে তা বাজারজাত করেছেন।

বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ নামে একজন ছিলেন বলে, তার জীবনের এপিঠ-ওপিঠ দর্শকদের কাছে নিজ হাতের তালুর মতো পরিচিত বলে ডুব নামক টেলিফিল্মটি বুঝতে খুব-একটা কষ্ট করতে হয় না। হুমায়ূন আহমেদ নামে এই ব্রহ্মাণ্ডে কেউ যদি না থাকতেন, তা হলে ডুবের মাথামুণ্ডু আবিষ্কার করতে প্রত্নতাত্ত্বিকের শরণাপন্ন হতে হতো।

বিয়ের সময়ে হুমায়ূন আহমেদের বাবা জীবিত ছিলেন না, ডুবে বিয়ের সময়ে ইরফানের বাবা বেঁচে ছিলেন; হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ঘরে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে এবং দ্বিতীয় ঘরে এক মেয়ে ও দুই ছেলে ছিল, ডুবে তা থেকে কয়েক পিস কমিয়ে ইরফানের প্রথম ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং দ্বিতীয় ঘরে এক ছেলে রাখা হয়েছে; নুহাশ বাবার মরদেহ দেখতে শহীদ মিনারে হলুদ পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন, ডুবে ইরফানের ছেলে এসেছিল শাদা পাঞ্জাবি পরে।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের গোঁফ আছে এবং চশমা পরেন, ডুবে ইরফানের ছোটভাই নাদের চৌধুরীর গোঁফ নেই এবং চশমাও পরেন না; শাওন কখনও নুহাশপল্লির দেয়াল টপকে ঢুকে জানালা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাথে ধূমপান করেননি, ডুবে পার্নো নয়নতারার দেয়াল টপকে ঢুকে জানালা দিয়ে ইরফানের সাথে উপর্যুপরি সিগ্রেট ভাগাভাগি করেছেন— পার্থক্য বলতে এই-ই।

ডুবে এর বাইরে যা কিছু দেখানো হয়েছে, মোটামুটি সবটুকুই হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে দিনে-দুপুরে চুরি করে নেওয়া। গুলতেকিন এখন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, ডুবে ইরফানপত্নী রোকেয়া প্রাচীও স্কুলে পড়ান; হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ির নাম নুহাশপল্লি, ইরফানের নয়নতারা; হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে মুহম্মদ জাফর ইকবাল যা-যা বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ডুবে ইরফানের মৃত্যুর পর তার ছোটভাই নাদের চৌধুরী হুবহু একই বক্তব্য দিয়েছেন!

পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ থাকলেও একজনও খারাপ বাবা নেই— জীবনের শেষদিকে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম আলোয় এই মর্মে বহুলপঠিত একটি কলাম লিখেছিলেন, ডুবেরও শেষদিকে ইরফান তিশাকে ফোন করে নিজেকে 'খারাপ বাবা' বলে অভিহিত করে ক্ষমা চেয়েছেন। এভাবে পাই-টু-পাই কপি করেও তা অস্বীকার করেছিলেন এবং অস্বীকার করে চলছেন ডুবের পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

গোটা দর্শকসম্প্রদায়কে মূর্খ ভেবে, কেবল নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে পরিচালক ফারুকী ঔদ্ধত্যের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেজে বসে ছিলেন এবং নেতিবাচক রিভিউয়ের বন্যা বইয়ে দর্শকরা ফারুকীকে সমুচিত জবাবও দিয়ে চলছেন। স্পার্টাকাস একাত্তর, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ফোর টোয়েন্টি, মেইড ইন বাংলাদেশের মতো দুর্দান্ত-দুঃসাহসী সৃষ্টিকর্মের স্রষ্টা ফারুকী ডুব টেলিফিল্মে কেন এমন শঠতা, মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় নিলেন এবং 'ডুবের পঁচানব্বই শতাংশ হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে নেওয়া' কথাটা বলার মতো সৎ সাহসটুকু কেন দেখাতে পারলেন না, ভেবে তাজ্জব হতে হয়।

ফারুকী ব্যাপারটা শুরু থেকেই স্বীকার করে নিলে এবং হুমায়ূনের দুই পরিবারের সাথে আলোচনা করে প্রকাশ্যে বায়োপিক বানালে ডুব টেলিফিল্মটা ফিল্ম হতে পারত, নির্ভয়ে করা যেত বলে গোটা কাজটা নিখুঁত ও প্রাণবন্তও হতো এবং বিরতিতে হলত্যাগ করা থেকে দর্শকদেরকে বিরতও রাখা যেত।

বায়োপিক বানাতে গিয়েও শতভাগ বায়োপিক না বানিয়ে, বায়োপিক না বানাতে গিয়েও প্রায় বায়োপিক বানিয়ে ফেলে এবং দুকূলই রক্ষা করতে গিয়ে, আবার কোনো কূলই পুরোপুরি রক্ষা করতে না পেরে ফারুকী ভজকট পাকিয়ে ফেলেছেন, হাইপের মাধ্যমে জাতিকে কুমিরডিম্ব দেখিয়ে ফারুকী বস্তুত একটি টিকটিকি-ডিম্ব প্রসব করেছেন এবং সাধারণ দর্শকরা তাকে তুলোধুনো করলেও তার ভাইবেরাদরবর্গ ঐ টিকটিকি-ডিম্বটি মামলেট করে আব্বাস কিয়োরোস্তমির নামে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন।

একজন লেখক, শিল্পী বা নির্মাতার যে ন্যূনতম সততাটুকু থাকা আবশ্যক; ডুবে ফারুকী এর পরিচয় দিতে পারেননি। অসততার মাধ্যমে বিদেশী সাফাই যোগাড় করতে পারলেও দেশে তা ধরা পড়ে যাবেই, মিথ্যাচার দিয়ে কিছু দিনের জন্য কিছু লোককে ভুলিয়ে রাখা গেলেও গোটা জাতিকে চিরদিন ভুলিয়ে রাখা যায় না; অসততা ও মিথ্যাচারের পতন হয়ই।

আড়াই মিনিটের মতো দৃশ্য কর্তনসাপেক্ষে সেন্সর বোর্ড ডুবকে ছাড়পত্র দিয়েছে। সেসব দৃশ্যের একটিতে দেখানো হয়েছিল ইরফান খান ফার্মেসি থেকে কনডম কিনছেন এবং আরেকটিতে দেখানো হয়েছিল কামনাতাড়িত হয়ে পার্নো ইরফানের দরজায় দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে নিজের এক পা দিয়ে আরেক পা ঘষছেন।

ডুব এমনিতেই ডুবে গেছে, এসব দৃশ্য থাকলে ডুব পাতালে গিয়ে ঠেকত। সেন্সর বোর্ডের নির্দেশে দৃশ্যগুলো কর্তনে রাজি হওয়ায় বা রাজি হতে বাধ্য হওয়ায় ফারুকীর ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই টেলিফিল্মের ইতিবাচক দিক হচ্ছে শারমিন সুলতানা সুমির গাওয়া 'আহা রে জীবন' গানটি।

গানটি সত্যিই হৃদয়স্পর্শী, গানের বাণীও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। আইসক্রিম ও আয়নাবাজি চলচ্চিত্রেও সুমি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ডুবের এই গানটি তাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেল। আংশিক ব্যবহার না করে পরিচালক পুরো গানটি টেলিফিল্মটিতে ব্যবহার করলে দর্শক অন্তত পাঁচটি মিনিটের জন্য আন্দোলিত হতে পারত।

একটি মিথ্যেকে ঢাকতে আরো অজস্র মিথ্যের প্রয়োজন হয় বলে কথিত আছে। ন্যূনতম সততার পরিচয় দিয়ে ফারুকী একবার সব স্বীকার করে নিলে তাকে গণরোষের মুখে পড়তে হতো না। ভুবনমাঝি, সত্তা, ভয়ঙ্কর সুন্দর নামে যে কথিত চলচ্চিত্রগুলো গত এক বছরে সাড়ম্বরে মুক্তি পেয়েছে; এর একটিও আলোচনাযোগ্য না। ডুবও ঐ কাতারেরই বস্তু।

ডুবের ট্রেলারে যা দেখা গেছে, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে এর বেশি কিছুর দেখা মেলেনি। ডুবে কোনো টুইস্ট নেই, ক্লাইম্যাক্স নেই। হুমায়ূন আহমদ নামক বটবৃক্ষকে জড়িয়ে না ফেললে ডুব নিয়েও কোনো আলোচনা করতাম না। ডুব বিদেশী উচ্চমার্গীয় উৎসবগুলোতে পুরস্কৃত হয়েছে বলে শুনেছি, শুনেছি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকাগুলো ডুবের উচ্চকিত প্রশংসা করেছে। তা হলে ডুব বিদেশী বোদ্ধাবর্গের প্রোজেক্টর প্রোজেক্ট হয়েই রইল, ডুব আমাদের মতো বুদ্ধুবর্গের জন্য না।

পুনশ্চ : হুমায়ুন আজাদ বলেছেন— আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে।

(লেখা : কবি ও লেখক আজাদের ফেসবুক আইডি থেকে)

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে