বিনোদন ডেস্ক: সত্যি বলতে কি, প্রযোজক অবতারে দেব আবির্ভূত হওয়ার পর, তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ‘চ্যাম্প’ খুব খারাপ লাগেনি। অন্তত দেব যা ভাবছেন বা তাঁর হয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের মধ্যে বাণিজ্যিক ধারায় নতুন কিছু করার একটা ইচ্ছা আছে বলে মনে হয়েছিল। বৃহত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছোনোর জন্য দেব যে অভিনয়ের পেছনেও সময় দিচ্ছেন, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল। বাঙালি যে মাত্রার নায়ক-অভিনেতাদের দেখেছে, তাতে দেবের অভিনয় হজম করা কঠিন হলেও, চেষ্টাটা অস্বীকার করা যায় না।
‘ককপিট’-এ উঠে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন দেব। পাইলটের চরিত্রে তাঁকে চমৎকার মানিয়েছে। গোটা ছবিটি তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে টেনেছেন। বন্ধু, প্রেমিক, স্বামী, পেশাদার হিসেবে সংলাপ প্রক্ষেপণে যথেষ্ট পরিণতি দেখানোর চেষ্টা করেছেন (যা তাঁর বহু পরিচিত দুর্বলতা)। সত্যি বলতে কি, শুধু দেব নয়, বাংলা মূল ধারার ছবির সাম্প্রতিক ইতিহাস মেনে ‘ককপিট’ ছবিটি দেখতে ভালোই। পয়সাকড়ি যে ভালোই খরচ হয়েছে, তা বোঝা যায়। তবে সব কিছুর পরেও যেটা হওয়ার ছিল, তাই হয়েছে। গলদটা গোড়াতেই থেকে গেছে।
পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
ডাক্তারি পড়তে গেলে মেধাবী হতে হয়। কিন্তু পড়াশোনার খরচ তো জনগণের করের টাকায় চলে। তাই ডাক্তারি পড়ে সেই জ্ঞান জনগণের কাজে না লাগোনোটা অপরাধ নিশ্চই। তা-ও যদি বুঝতাম, তিনি সংস্কৃতিকে পেশা হিসেবে নিয়ে বাংলা সিনেমায় কিছু মৌলিক অবদান রাখছেন(ভারতের যে কোনো নাগরিকের তাঁর ইচ্ছা মতো পেশা বেছে নেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার আছে, সেটা মেনেই স্রেফ ঔচিত্য বোধে এ কথা বললাম)। কমলেশ্বর নিজেকে কী মনে করেন, প্রযোজকরা কেন তাঁর ভরসায় পয়সা ঢালেন – এই দুই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গোটা ‘ককপিট’ ছবিতে লিপসিঙ্ক হয়নি। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, সামান্য রিভিউয়ারের চেয়ে প্রযোজকদের বুদ্ধি নিশ্চয় বেশি। এটা বোধহয় নতুন কোনো আর্ট ফর্ম।
সিনেমাটা কেন, কিছুই বোঝা গেল না। দেবের পাইলট বাবা প্লেন ক্র্যাশে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু দেব দুরন্ত কৃতিত্ব দেখিয়ে ১৪৬ জন যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন। দেবের আগমার্কা দর্শকদের কাছে প্লেনের সমস্যাগুলো কতটা সুবোধ্য হবে বলা মুশকিল। তাই তাঁদের নায়ক, কী দুর্দান্ত কাণ্ডটাই না ঘটালেন, সেটাও তাঁদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন। বাকি রইলেন, যাঁরা বিষয়টা বোঝেন। কিন্তু তাঁরা কেন দেবের দুরন্ত পেশাদারি দক্ষতা দেখার জন্য টিকিট কেটে হলে যাবেন!
না, ভুল হল। ছবিতে আরও নানা কিছু আছে। দু’জন নায়িকা আছেন। যাঁদের মধ্যে কী ভাবে পরিচয় হল জানা যায় না। কিন্তু এক জনের প্রেমে আঘাত ভোলাতে অন্য জন তাঁর ফ্ল্যাটে হাজির হয়ে যান। কোয়েল কখন কলকাতায় রয়েছেন, কখন কেন মুম্বইতে গেলেন, কেউ বুঝতে পারলে জানাবেন প্লিজ।
দেব কেন স্রেফ ‘ভালো বন্ধু’ রুক্মিনীকে গয়না উপহার দেন অথচ তাঁকেও ছুঁয়েও দেখেন না, তা-ও বোঝা যায় না। রুক্মিনীকে যতক্ষণ ‘অভিনয়’ করতে হয়নি, ততক্ষণ তাঁকে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু যেই অভিনয় করার প্রয়োজন হয়েছে, তিনি দায়িত্ব নিয়ে ধেড়িয়েছেন।
প্লেনের যাত্রীদের চরিত্রগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেকটা সময় ব্যয় করা হয়েছে ছবিতে। অনেকগুলো চরিত্রের ব্যক্তিগত সংকটের সঙ্গে দর্শককে পরিচিত করানো হয়েছে। কিন্তু প্লেনের সংকটময় যাত্রায় সেগুলো তেমন ভাবে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু শুরুটা দেখে আশা জেগেছিল, হয়তো ওই ছোটো ছোটো গল্পগুলো নতুন কোনো পরিণতি পাবে বা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে ছবির শেষে- তা হয়নি। জীবনমরণের সমস্যার সামনে ব্যক্তিগত সমস্যা অনেক সময়ই গৌণ হয়ে যায়, এই অতি সাধারণ মানবিক ব্যাপারটা কি ছবি বানানোর বিষয় হতে পারে? জানি না। জানি না, প্লেন থেকে নামার কিছুক্ষণ পরে চরিত্রগুলোর জটিল ব্যক্তিজীবনে ওই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা কেমন প্রভাব ফেলবে বা আদৌ প্রভাব ফেলবে কি না। এক কথায় বলতে গেলে ছবিটার কোনো ফোকাস নেই। নেই কোনো বৃহত্তর নাটকীয়তার শিল্পটান।
দেব এর চেয়ে একটা নাচেগানে জমজমাট ছবিই করতে পারতেন। কিন্তু অত ছোটো ক্যানভাসে কমলেশ্বরের প্রতিভা চেনা যেত না। যে প্রতিভার হাত থেকে মেঘে ঢাকা তারা, ক্ষত-র মতো ট্র্যাশের পরও বাঙালি ফিল্ম দর্শক নিস্তার পাচ্ছেন না। আবার তাঁদের শীতে আমাজনে যেতে হবে। সেই অভিযানে কমলেশ্বরের মতো সঙ্গীকে পেয়ে এখন থেকেই বুক দুরুদুরু শুরু হওয়ার কথা। চাঁদের পাহাড়ে তাও ম্যাচ বাঁচাতে স্বয়ং বিভূতিভূষণ ছিলেন।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি