জয়ার সেই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে ভারতেও
বিনোদন ডেস্ক: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া অভিনেত্রী জয়া আহসানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত কিছুদিন থেকে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি ভারতের শ্রীজিৎ মুখার্জির রাজকাহিনী (টেল অব কিংস) ছবিতে একটি দৃষ্টিকটু দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। ফেসবুকে জয়া আহসান বিরোধী অনেক মন্তব্য স্থান পেয়েছে। মন্তব্যকারীরা জয়ার সমালোচনায় সোচ্চার। কিন্তু দৃশ্যটি কতোটা দৃষ্টিকটু বা আদৌ দৃষ্টিকটু কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ। সৃজনশ্লীলতায় বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক আলোচনা, অনেক তর্ক হয়েছে। কেউ এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। নান্দনিকতার প্রশ্নে এক কথায় এর জবাব হলো, যা দৃষ্টিনন্দন নয় । বিষয়টা একেবারেই আপেক্ষিক। সুতরাং হুট করে কোনো মন্তব্য করাটা শুধু জয়া নয়, সেই কাজটিকেও নস্যাৎ করে দেওয়ার শামিল। আলোচিত রাজকাহিনী ছবিটির কাজ শেষ হয়েছে গত জুন মাসে এবং মুক্তি পেয়েছে গত ১৬ অক্টোবর। কিন্তু সমালোচনার ঝড়টা উঠেছে অনেকটা বিলম্বেই বলা যায়। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার সেই দৃশ্যটির একটি ভিডিও ক্লিপিংও প্রচার করেছে, যা এদেশের অনলাইন এবং পত্রপত্রিকাও ফলাও করে প্রচার করেছে। দৈনিকটি বিতর্কীত তারকা সানি লিওনের সঙ্গে তুলনা করে প্রচারিত প্রতিবেদনে জয়াকে ফতোয়াবাজির শিকার হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে জয়ার বক্তব্যও উপস্থাপন করা হয়। তাতে তিনি বলেছেন, ‘এ ছবিতে রুবিনার ভূমিকায় ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছি। আর এখানে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ সব শিল্পীরা ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে তুলনায় আমার পর্দায় উপস্থিতি অন্য সবার চেয়ে বেশি। এতে অভিনয় করার মানে হচ্ছে ঐতিহাসিক একটা কাজের অংশ হয়ে থাকা। বাংলাদেশের একজন শিল্পী হিসেবে তারা সম্মান করে আমাকে নিয়ে গেছেন। আমি তাদের ছবিতে অভিনয় করেছি। সেটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। অভিনয়ের জায়গাও ছিল। দর্শকরা দেখলে বাকিটা বুঝতে পারবেন।’ কি ছিল ছবিটির গল্পে? ১৯৪৭ সালে চূড়ান্তভাবে বাংলা বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর দুই অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি পতিতালয়কে কেন্দ্র করে গল্পের আখ্যান ভাগ গড়ে উঠেছে। এই পতিতালয়টি পরিচালনা করে ১১ জন নারী। তাদেরই একজনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। উল্লেখ করার বিষয় হলো, রাজকাহিনী নামটি নেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজকাহিনী গল্প সংকলন থেকে। এই নামে একটি মঞ্চ নাটকও আছে। এই ছবিটিতে কাজ করে জয়ার উপলব্ধি হলো তিনি ‘ঐতিহাসিক’ কাজের অংশ হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে ছবিটি ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক ছবির সজ্ঞা কি? একটি চলচ্চিত্র কি কখনো কোনো জাতির ইতিহাস হতে পারে? ইতিহাসতো কাল্পনিক গল্প নয়। ইতিহাস হলো ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রামাণ্য দলিল। ইতিহাসের উপাদান বা কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তিকে নিয়ে একটি ছবি নির্মিত হতে পারে। তাই বলে সেই ছবিটি ইতিহাস হয়ে উঠেনা। আমাদের দেশে নবাব সিরাউদ্দৌলা নিয়ে ছবি নির্মিত হয়েছে। সে ছবিতে আলেয়া নামে একটি চরিত্র আছে। নাট্যকার নির্মলেন্দু লাহিড়ী এ চরিত্রটি যথাযথ ব্যবহার করেছেন তার সিরাজউদ্দৌলা নাটকে। কিন্তু সেই আলেয়া চরিত্রটি ইতিহাসে নেই। এদেশের যারা (প্রথমে আনোয়ারা ও পরে অনজু) এ চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন। তারা কি অহংকার করে বলতে পারেন যে তারা ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন? নবাব চরিত্রের সফল অভিনেতা আনোয়ার হোসেনও কখনো বলেননি যে তিনি বাংলার ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। মুম্বাইতে মোগল সম্রাট আকবরের অন্দর মহলের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে মুগল-ই-আযম। ইতিহাস কি বলতে পারবে আকবরের অন্দরমহলের ঘটনা সেরকমই ছিল। কিংবা আনারকলি কে ছিলেন। ইতিহাসে যে চরিত্রের অস্তিত্ব নেই, শুধু লেখকের সৃজনশ্লীলতার স্বার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে চরিত্রটি ঐতিহাসিক হয় কিভাবে? সম্রাট আকবরেরর চরিত্রে অভিনয় করে পৃথ্বী রাজকাপুরও ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেননি। তেমন দাবিও তিনি করেননি। কিং বেনসলে গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেননি। ক্লিওপেট্রা চরিত্রে অভিনয় করে সোফিয়া লোরেন কখনোই দাবি করেননি যে, তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। জয়া আহসান এদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গেরিলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। তখন তিনি বলেননি ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। তাহলে তিনি কি মনে করেন এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস নয় ? জয়া হয়তো আগপিছ ভেবে কথাটা বলেননি। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, কিছু কিছু নির্মাতা আছেন যারা বিভিন্নভাবে গবেষণা করে তাদের সৃজনশ্লীলতায় ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহকে যথাযথ তুলে আনতে চান তাদের সৃজনশীলতায় কিংবা জীবনীভিত্তিক ছবিগুলোতে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে উপস্থাপন করতে চান। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্টদের মনের গভীরে লালন করা নানা উপাদানও স্থান পায়। নিরেট বাস্তবতা কখনো শিল্প হয় না। অদ্বৈতমল্ল বর্মণ লিখেছেন তিতাস একটি নদীর নাম এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন পদ্মানদীর মাঝি। দুটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু জেলে জীবন। এর একটি কালোত্তীর্ণ, আরেকটি নয়। কেন? অদ্বৈতমল্ল বর্মণ হলেন জেলের সন্তান। তাই জেলে জীবন, জেলেদের কৃষ্টি-কালচার, জীবনযাপনসহ সবকিছুই তার মজ্জাগত। তাই তিতাস একটি নদীর নাম হয়ে উঠেছে জেলে জীবনের বাস্তব চিত্র। শুধু বাস্তব নয়, বাস্তবের চাইতেও বাস্তবিক। অন্যদিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলে জীবন দেখেছেন দূর থেকে। তাই পদ্মানদীর মাঝিতে তিনি তার দেখা জেলে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন কল্পনা। সৃষ্টি করেছেন হোসেন মিয়ার মতো একটি রহস্যময় চরিত্র, যার স্থান হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যে। শিল্পের প্রথম শর্তই হচ্ছে, বাস্তবের কল্পনার মিশেল থাকতে হবে। শিল্পতত্ত্বে বলাই আছে, ডকুমেন্টেশন অব লাইফ ইজ নট আর্ট। সুতরাং তিতাস একটি নদীর নাম জীবনের বাস্তবচিত্র হওয়া সত্ত্বেও সেটি কালোত্তীর্ণ হতে পারেনি। কালোত্তীর্ণ হয়েছে পদ্মানদীর মাঝি। তাই শিল্প-সাহিত্যে ক্ল্যাসিক বলে একটা কথা আছে। এ ধারার ছবিগুলো কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের মতোই এক সময় ধ্রুপদ শিল্পকর্ম হিসেবে সৃজনশীলতার ইতিহাসে স্থান পেয়ে যায়। তার অংশীদার একজন পারফর্মার হতেই পারেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ