বলিউডের যুদ্ধে চাল হলিউডের
বিনোদন ডেস্ক : অন্ধকার জগতের মতো কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলছে বলিউড। ‘সোডা ওয়াটারের’ খবর কী? কেমন বিক্রি হচ্ছে ‘এইটটিন ইয়ার্স স্কচ’?
আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথার তর্জমাটা করে ফেলা যাক। শাহরুখ-কাজলের ‘দিলওয়ালে’ হল ‘সোডা ওয়াটার’। আর রণবীর সিংহ, দীপিকা, প্রিয়ঙ্কার ‘বাজিরাও মস্তানি’ নাকি ১৮ বছরের পুরনো স্কচ হুইস্কি। প্রভূত ঢাকঢোল-সহ শুক্রবার মুক্তি পাওয়া দু’টো ছবিই যাঁরা দেখে ফেলেছেন, তাঁদেরই একটা বড় অংশ এই নামকরণের নেপথ্যে। যদিও এঁদের অনেকেই আক্ষেপ করে বলছিলেন, এত প্রতীক্ষিত দু’টো ছবি স্রেফ একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে একই দিনে রিলিজ না করলেই ভাল করত।
সেই প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত আসা যাবে। আগে ‘কোড’-এর নেপথ্য কাহিনিটা হোক।
বলিউডের একটা বড় অংশ মনে করছে, উৎকর্ষের দিক থেকে সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘বাজিরাও’ বহু অংশে টেক্কা দিয়েছে ‘সিংহম’-খ্যাত রোহিত শেট্টির ‘দিলওয়ালে’কে। যদিও প্রথম দিন বক্স অফিস থেকে ‘দিলওয়ালে’ কামিয়েছে ২১ কোটি। ই-মেলে এই দাবি শাহরুখের প্রচার সচিবের। অন্য দিকে ‘বাজিরাও’-এর প্রযোজক ইরস ইন্টারন্যাশনালের দাবি, প্রথম দিন ৩০৫০টা হল থেকে তাদের মোট আয় ১২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা।
তা সত্ত্বেও প্রথম দিনের আয় দেখেই বিজয়ীর ট্রফি কেকেআর মালিকের হাতে তুলে দিতে রাজি নন অনেকেই। কারণ, তাঁরা মনে করছেন, প্রচারের ঘনঘটা আর শাহরুখের ‘মহাতারকা’ ইমেজে অনেকটা ভর করে শুক্র-শনি হয়তো একটু এগিয়ে রয়েছে ‘দিলওয়ালে’। কিন্তু ‘রাজ-সিমরন’ জুটি ছাড়া এ ছবিতে দর্শনীয় বিশেষ কিছু নেই। সোডা ওয়াটারের বোতল খুললে প্রথমে যেমন খানিকটা ফেনা ভসভস করে বেরিয়ে আসে, ‘দিলওয়ালে’র প্রথম দু’দিনের ব্যবসা সে রকমই খানিকটা হুজুগ আর খানিকটা অন্ধ ভক্তদের পাগলামিতে ভর করেই এগিয়েছে।
তাই বলিউডের এই অংশের মতে, সোমবার থেকে হুজুগ কমে আসবে, ‘ঝাঁঝ’ কমবে সোডা ওয়াটারের। কিন্তু দিন যত যাবে, পুরনো হুইস্কির মতোই কদর বাড়বে ‘বাজিরাও’-এর। কারণ, এ ছবির রেশ দীর্ঘস্থায়ী। হল-ফেরত দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, যাকে ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’
বলা হয়, আর সমালোচকদের সুচিন্তিত মতামত— দু’টোরই পাল্লা ভারী কিন্তু ‘বাজিরাও’য়ের দিকে।
বলিউডের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ আমোদ মেহরা বলছিলেন, ‘‘দিলওয়ালে নিয়ে শাহরুখ যা পাবলিসিটি করেছিলেন, তাতে প্রথম উইকএন্ডে তিনি এগিয়ে থাকবেন, জানা কথা। যেটা জানা ছিল না, সেটা হল শাহরুখ-কাজলকে দেখতে গিয়ে লোকে একটা রদ্দি ছবিও দেখবে। এখানেই ‘দিলওয়ালে’র খামতি।’’ আর ‘বাজিরাও’? আমোদের কথায়, ‘‘ছবি যে দেখে বেরোচ্ছে, সে-ই বন্ধুদের বা পরিবারকে ছবিটা দেখতে বলছে। সোমবার সকাল থেকে এটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে।’’
একই কথা বলছেন কলকাতার দর্শকদের কেউ কেউ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সৌভিক চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমি শুক্রবারই দু’টো ছবি দেখেছি। শাহরুখ-কাজলের ফ্যান বলে প্রথমে ‘দিলওয়ালে’ দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বলতে খারাপ লাগছে, দিনের শেষে বেশি ভাল লেগেছে ‘বাজিরাও’।’’ উল্টো মতও আছে। কলেজের অধ্যাপিকা মৌ সরকার বললেন, ‘‘রোহিত শেট্টির ছবিতে অত গল্প দেখতে যাব কেন? আমরা ১১ জন মিলে কলেজ থেকে গিয়েছিলাম শাহরুখ-কাজলকে দেখতে। আমাদের দুর্দান্ত লেগেছে।’’
‘দুর্দান্ত’ কিছু চমক অবশ্য ট্রেলার থেকেই দেখাচ্ছিল দুই শিবির। এক দিকে আইসল্যান্ডের হিমবাহের ওপরে শাহরুখ-কাজলের ‘গেরুয়া’, অন্য দিকে ‘বাজিরাও’-এর যুদ্ধের ঝলকে অস্ত্রের বিপুল ঝনঝনানি— জমি তৈরি ছিলই। কিন্তু সেই জমিতে ‘দিলওয়ালে’ বনাম ‘বাজিরাও’ যুদ্ধটা না বাধলেই ভাল হতো বলে অনেকে মনে করছেন। তাঁদের মতে, নিজের নিজের ছবি রিলিজকে পুরোদস্তুর ইগোর লড়াইয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছেন শাহরুখ ও সঞ্জয় লীলা বনশালী। শাহরুখের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলছিলেন, ‘‘২০০৭-এ ‘সাওয়ারিয়া’ এবং ‘ওম শান্তি ওম’-এর সময় থেকেই এটা চলে আসছে। এ সব না করে এ বার একটা ছবির মুক্তির দিন একটু আগে-পরে করলেই হতো। তা হলে দু’টো ছবিই হাসতে হাসতে প্রথম দিন ৩০ কোটির কাছাকাছি ব্যবসা করত। এই ক’বছরে ছবি বানানোর খরচ অনেক বেড়েছে, তাই ক্ষতিটা গায়ে লাগছে।’’
একই কথা বলছেন তরণ আদর্শের মতো বাণিজ্য বিশেষজ্ঞও। তাঁর কথায়, ‘‘দু’টো ছবিরই ক্ষতি হল, কারণ দর্শক ভাগাভাগি হয়ে গেল। না-হলে একটা ছবি ২১ কোটি, অন্য ছবিটা ১৩ কোটির কাছাকাছি ব্যবসা করেছে। যদি একক ভাবে রিলিজ হত, তা হলে সংখ্যাটা ৩৪ (২১+১৩) না হলেও ৩০-এর কাছাকাছি যেত।’’ তবে তরণ জানাচ্ছেন, ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনও বড় হিন্দি ছবি নেই। তাই দু’টো ছবিই ভাল চলবে বলে তিনি আশাবাদী।
এখানেই তুরুপের তাস খেলেছে হলিউড। ভারতীয় ‘স্টারদের’ যুদ্ধের আঁচে পড়ে দর্শক হারানোর ঝুঁকি নিতেই চায়নি ‘স্টার ওয়ার্স: দ্য ফোর্স অ্যাওয়েকেনস্’!
মুক্তির আগে থেকেই ছবিটা ঘিরে গোটা বিশ্বে ‘চরম উন্মাদনা’ চলেছে বললেও কম বলা হয়। মহাকাশ-যুদ্ধের কিংবদন্তি সিরিজের বহুপ্রতীক্ষিত ছবি। অনলাইন স্টোর থেকে কেনা লাল-নীল আলো জ্বলা তরোয়াল নিয়ে আমেরিকা-ইউরোপের সিনেমা হলগুলোর সামনে বসে গিয়েছে ভক্তদের নকল যুদ্ধের মহড়া। আর বক্স অফিস? সব রেকর্ড চুরমার। শুধু আমেরিকাতেই এ পর্যন্ত ২১ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের বেশি ব্যবসা করেছে ছবিটা। বৃহস্পতিবার আমেরিকা ও কানাডায় মুক্তির পর শুধু সেই রাতের মধ্যে আয় হয়েছিল ৫ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার। ভারতীয় হিসেবে ৩৭৭ কোটি টাকা! এর আগের রেকর্ড ছিল ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড ডেথলি হ্যালোজ পার্ট টু’-এর— ৪ কোটি ৩৫ লক্ষ ডলার। রেকর্ড-ভাঙা ব্যবসা হয়েছে ব্রিটেনেও।
এই ‘স্টার ওয়ার্স’-এরই ভারতে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ‘দিলওয়ালে’ আর ‘বাজিরাও’-এর সঙ্গে একই দিনে— ১৮ ডিসেম্বর। হঠাৎ করেই ছবির মুক্তি এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয় প্রযোজক ‘ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওজ’। নতুন দিন ঠিক হয় ২৫ ডিসেম্বর। কেন? মুম্বই থেকে ডিজনির এক বড় কর্তা বললেন, ‘‘স্টার ওয়ার্সের মুক্তি পিছিয়ে দেওয়াটা আমাদের একটা ‘স্মার্ট বিজনেস মুভ’। দু’টো হিন্দি ছবি একই দিনে রিলিজ করে নিজেদের ব্যবসার বিরাট ক্ষতি করেছে। আর আমরা সিনেমা হলের সংখ্যাও কম পাচ্ছিলাম। আমাদের কোনও ইগো নেই। তাই মুক্তি পিছিয়ে দিলাম!’’ ভারত ছাড়া গ্রিস ও চিনে এখনও
মুক্তি পায়নি ‘স্টার ওয়ার্স’।
ডিজনি মনে করছে, জানুয়ারিতে চিনে মুক্তির পর সেখানেও বিরাট ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে গোটা বলিউডই তারিফ করছে হলিউডের এই তীক্ষ্ণ ব্যবসায়ী বুদ্ধির। বলে রাখা দরকার, ওই ১৮ তারিখেই কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেয়েছে ‘হর হর ব্যোমকেশ’। রিপোর্ট বলছে, দুই হিন্দি ছবির চাপে বক্স অফিসে এখনও তেমন আগুন ধরাতে পারেননি ‘ব্যোমকেশ’ আবির চট্টোপাধ্যায়। আইনক্সের তরফে পঙ্কজ লাডিয়া বলছেন, ‘ব্যোমকেশ ভাল ছবি, শনিবার বিকেলে মাল্টিপ্লেক্সে হাউসফুলও হয়েছে। কিন্তু দু’টো বড় হিন্দি ছবির মাঝখানে পড়ে প্রথম উইকএন্ডে একটু হলেও ক্ষতি হবে বক্স অফিস কালেকশনের। আমাদের ধারণা, এক বার স্কুল-কলেজে ছুটি পড়ে গেলে, ২৪ ডিসেম্বর থেকে দশ দিন খুব ভাল ভিড় হবে।’’ ২৫ ডিসেম্বর আরও একটা বাংলা ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা— ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ অবলম্বনে অপর্ণা সেনের ‘আরশিনগর’। তবে কেউ কেউ বলছেন, স্টার ওয়ার্সের সঙ্গে এক দিনে রিলিজ হলেও ব্যবসা মার খাওয়ার ততটা ভয় নেই ‘আরশিনগর’-এর। কারণ, দু’টো ছবির মূল দর্শক আলাদা।
বড়দিনের আগে অবশ্য নজর থাকছে সোমবারে। যখন প্রথম কয়েক দিনের পাগলামির পর একটা স্থিতাবস্থায় পৌঁছবে ‘দিলওয়ালে’ ও ‘বাজিরাও’।
সে দিন থেকে দেখার, সোডা ওয়াটার বনাম স্কচ-এর লড়াইয়ে ‘চিয়ার্স’ বলে কে! সূত্র : আনন্দবাজার
২০ ডিসেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস
�