‘জানতাম বাবা আছেন, ডুবলে ঠিক বাঁচাবেন’
কোয়েল মল্লিক : চু...উ...উ...উ কিৎ...কিৎ....বাড়ির বারান্দায় দাদাদিদিদের সঙ্গে মজে গেছি খেলায়। হঠাৎ দেওয়াল ঘড়ির ঢংঢং আওয়াজ কানে এল, খেলতে খেলতে হঠাৎ পেন্ডুলামের ঘণ্টা শুনলাম —আটটা। বাবার আসার সময়। এই সময়টার জন্যই রোজ অপেক্ষা করতাম আমি।
বারান্দা থেকে নেমেছে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধের গলা ‘রঞ্জিতবাবু বাড়ি আছেন?’ খেলা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম আমরা। ছোড়দি পাকা গিন্নির মতো বলল, ‘‘উনি তো এখনও বাড়ি ফেরেননি। কিছু বলার আছে?’’ কিছুক্ষণ চুপ। তারপরই ভীষণ জোরে হাসির আওয়াজ।
সিঁড়ির আলোয় এতক্ষণে দেখা গেল তার মুখ। আর কেউ না, বাবা। কিছু দিন অন্তর অন্তর এমনই করে বাবা শ্যুটিং থেকে ফিরতেন। কখনও বৃদ্ধ, কখনও মহিলা আবার কখনও বা বাচ্চার গলা করে ডাকতেন—কেউ বুঝত না শুধু আমি ছাড়া। এক রকমের পারফিউমের গন্ধ পেলেই বুঝে যেতাম বাবা কাছাকাছিই আছেন, তাই আমাকে কোনও দিনও ফাঁকি মারা যেত না।
বাইরের লোকে যদিও বাবাকে গম্ভীর ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখেন, তাঁর যে কী অসম্ভব রসবোধ তা আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি।
ছুটির দিনগুলোতে তাদের প্রিয় ন’কাকুর মুখে সিনেমার গল্প শুনতে সবাই বাবাকে ঘিরে বসত। বাবা অনর্গল বলে চলতেন সিনেমার সংলাপ, ততটাই নাটকীয় ভঙ্গিতে। মারপিটের বর্ণনার সময় দাদাদের চোখ উৎসাহে চকচক করে উঠত। যেন ওরাই গুণ্ডাদের সঙ্গে লড়ছে। রাতে ডিনারের আগে কিন্তু শুধু বাবা-মেয়ের গল্পই হত। বাবা শুয়ে থাকতেন, তাঁর পিঠে চেপে আমি। প্রায় প্রতিদিন একই কথা আওড়াতেন— ‘‘তোর জন্য নতুন বাবা নিয়ে আসব, সে তোকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘোরাতে নিয়ে যাবে।’’ মাঝখানে আমি থামিয়ে বলতাম — ‘না চাই না আমার নতুন বাবা। তুমিই ভাল।’
বাবা বলতেন, ‘‘ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে তোর সঙ্গে ফুচকা খাবে, তোকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবে, সার্কাস যাবে, নিউ মার্কেট যাবে।’’ আমিও একই উত্তরে অনড় থাকতাম। শেষমেশ বাবা আমাকে কাঁদিয়েই স্বস্তি পেতেন। বাকি বাবারা যা করতে পারতেন, যেহেতু বাবা পারতেন না, সেই অনুশোচনা থেকেই রোজ প্রশ্নোত্তরের পর্ব। যাক্, ভালবাসার টেস্টে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বাড়িতে গানের খুব চল ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ডি এল রায় থেকে আধুনিক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘পাল্কি চলে, হুউম না, হুউম না’র সঙ্গে বাবা নাচতেন। আর তার ছন্দে বাবার ঘাড়ে চেপে আমিও নাচতাম। ভবানীপুরের মল্লিক বাড়ির অনেকগুলো ঘরের একটির মধ্যে দোলের দিন বাবার সাহায্যে গা ঢাকা দিলেও, ঠিক যখন ভাবতাম পার পেয়ে গেছি, অমনি দাদাদের দল বাদুরে রং হাতে অ্যাটাক। একি! জানল কী করে আমি এখানে? বুঝতাম বাবাই আমায় লুকিয়ে সবাইকে খবর দিয়েছেন। তবুও আমি বোকা, প্রতি বছর বাবাকে বিশ্বাস করতাম, আর তার ফলও একই ভুগতাম।
একদিন বাবার সঙ্গে গাড়িতে বসে আছি। মা কিছু কিনতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ রাস্তায় একজন হাঁটতে গিয়ে বাবাকে দেখে আচমকা থেমে গেল। সে আবার কিছু জনকে ডেকে আনল। এই করতে করতে ভিড় অনেক বেড়ে গেল। এমন করে তারা গাড়ি ঘিরে ধরল যে দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। কিছুই বুঝতে না পেরে আমিও থতমত খেয়ে গেলাম।
কিন্তু কিছুক্ষণে টের পেলাম এক জন নাম করা লোক আমার বাবা। শেষমেশ পুলিশের সাহায্যে গাড়ি বেরোল। সেদিন কী আনন্দ! বাবার হাত জড়িয়ে ধরলাম। তার পর বাবার সিনেমা-থিয়েটার দেখতে গিয়েছি কত! চোখ থাকত আমার দর্শক-শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। প্যাকড দর্শকের কান ফাটানো হাততালি, বাহবা দেখে আমি একেবারে ক্লাউড নাইন।
প্রিন্সিপল, ভ্যালুজ, মরালস-এর অর্থ কী বাবা তার জীবনধারা দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই যেমন সূর্যোদয়কে প্রণাম করেন, বাবা সূর্যাস্তকে প্রণাম করে কৃতজ্ঞতা জানাতেন।
মনে পড়ে প্রচণ্ড গরমে বাবার শ্যুটিংয়ে যেতে হবে বাঁকুড়া। একটা অত্যন্ত ঝড়ঝড়ে গাড়ি এল বাবাকে নিতে। যার ম্যাক্সিমাম স্পিড বোধহয় পঞ্চাশ উঠবে কি না সন্দেহ। এসি তো দূরের কথা, কাচ উঠলে নামে না। বাবাকে বললাম প্রোডাকশন ম্যানেজারকে ফোন করতে। বাবা বললেন, ‘‘ছাড় কোনও ব্যাপার না। আমি না চড়লে, গঙ্গার কাজ যাবে।’’—কিন্তু তাই বলে তুমি এতটা পথ কষ্ট করে যাবে? আর প্রোডাকশনেরও বলিহারি! রঞ্জিতবাবু অত্যন্ত ভালমানুষ, অমায়িক, কিছু বলবেন না—বলে এত খারাপ গাড়ি পাঠাবে? মনে মনে রাগ হত। ভালমানুষ বলে তার মূল্য না দিয়ে, তার সুযোগ নেওয়ার মনোভাব আমার কিছুতেই বোধগম্য হয় না।
গ্র্যাজুয়েশনের সময় যখন আমার প্রথম সিনেমায় অভিনয় করার কথা উঠল, বাবা পাখি পড়ানোর মতো একটাই কথা বলতেন, ‘‘কাজের জায়গা, খুব সিরিয়াস, হানড্রেড পারসেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করবে, প্রোডিউসরের অনেক স্টেক, ডিরেক্টর ক্যাপটেন। দর্শক নিয়ে অনেক কথা।’’
প্রথম সিনেমা সমরেশ বসুর ‘নাটের গুরু’র শ্যুটিংয়ের প্রথম দিন। বাবা পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘যদি মনে করেন ও পারছে না, ওকে বাদ দিয়ে নতুনকে নিতে সংকোচ করবেন না।’’
চিরকাল যেহেতু প্রোটেকটেড জীবন কাটিয়েছি, সিনেমার পৃথিবীতে এসে ধাক্কা খেয়েছিলাম। বাবা স্ট্রিক্ট কোচের মতো জলে ঠেলে দিয়ে দেখতেন আমি কতটা সাঁতার কাটছি, জল খেয়েছি, ডুবেছি, আবার উঠেছি। জানতাম বাবা আছেন, ডুবলে ঠিক বাঁচাবেন।
দেখতে দেখতে বাবা হয়ে উঠেছেন আমার পরম বন্ধু। দেশবিদেশের নানা গল্প নিয়ে বেশ আড্ডা জমে আমাদের। কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দৌলতে বাবার বিশেষ পছন্দের সিনেমা দারুণ উপভোগ করেছি। আবার অপেক্ষায় আছি এই বছরের ফেস্টিভ্যালের জন্য।
প্রায় সব রকমের গল্পই হয় বাড়িতে। বাড়িতে যতটা মজার আড্ডা হয়, ততটাই গম্ভীর আলোচনা হয়। কোনও ব্যাপারে কনফিউশন থাকলে বাবার সঙ্গে কথা বললে নিমেষে সব পরিষ্কার। জীবনদর্শন প্রত্যেকটা পদে পদে শিখেছি তার কাছে।
লেখক : ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। -আনন্দ প্লাস
২৩ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস
�