ঐতিহাসিক রোমান্স ‘বাজিরাও মস্তানি’
সম্রাট মুখোপাধ্যায়: ‘মুঘল–ই আজম’ থেকে ‘যোধা আকবর’। হিন্দি ছবির দুই প্রান্তের দুই ‘কস্টিউম ড্রামা’। তার ভেতর দিয়ে এক ‘জার্নি’ তৈরি করলো যেন ‘বাজিরাও মস্তানি’। সঞ্জয় লীলা বনশালির সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক রোমান্স।
এ ছবির ‘পটভূমি’ থেকে ‘রাজনীতি— সর্বত্রই এত বড় একটা ‘ক্যানভাস’ বেছে নিয়েছেন সঞ্জয় যে, এ ছবিকে শুধু ‘ঐতিহাসিক’ না বলে ‘এপ্রিক’ বলাই শ্রেয়। প্রতিটি দৃশ্যের প্রতিটি ‘ফেম’ সেখানে মহিমান্বিত, ‘মাউন্টেড’। এই ‘মাউন্টিং’ ব্যাপারটা সঞ্জয় লীলা বনশালির সব ছবিতেই থাকে। ফলত, তা নতুন নয়, এ কথা সত্যি। কিন্তু এবারের ছবিতে দুটি ব্যাপার সঞ্জয় সযত্নে তার ছবিতে নিয়ে এসেছেন। যে দুটি উপাদানই তার এই ছবিতে ‘এপিক’ করে তুলেছে।
প্রথমত, এ ‘ছবির ফ্রেমিং’–য়ে আত্মা হিসেবে পরিচালক সঞ্জয় আর তার চিত্রগ্রাহক সুদীপ চট্টোপাধ্যায় ব্যবহার করেছেন রাজা রবি বর্মার নানা ‘পেইন্টিংস’–এর ধরতাইকে। ‘কম্পোজিশন’ ও ‘ডিটেলিংস সমেত। তার ফলে চিত্রনাট্যে যে দৃশ্য আপাত অনাটকীয় বা হয়ত কিছুটা ‘ফিলার’ দৃশ্যই, সে দৃশ্য থেকেও চোখ সরানো যাচ্ছে না।
এই সব ‘পেইন্টিংস’কে দর্শক চোখে ‘রেজিস্টার’ করতে একটু ধীর লয়ের সম্পাদনা–কৌশল নিয়েছেন সঞ্জয় ও এ ছবির সম্পাদক রাজেশ পান্ডে। প্রাধান্য দিয়েছেন ‘লং শট’ আর ‘টপ ভিউ শট’–কে। এই গোটাটাই এ ছবিকে ‘এপিক’–এর দৃশ্যরূপ দিয়েছে। এবং অবশ্যই এর সঙ্গে যোগ করতে হবে এ ছবির ‘সেট ডিজাইন’কেও। যা শুধু চোখ ধাঁধানোর উপাদান নয় বরং তার প্রতিটি ইঞ্চিতে লেগে আছে ‘পিরিয়ড পিস’কে মর্যাদা দেওয়া গবেষণা আর পরিশ্রমের ছোঁয়া। একই কথা খাটে পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও।
সবচেয়ে বড় কথা, ছবিতে রাজকীয় ‘গ্ল্যামার’–এর এত প্রাচুর্য সত্ত্বেও কোথাও তা ‘সিন্থেটিক’ লাগে না। তার কারণ, কৃত্রিমতাকে যথাসম্ভব এড়াতে সযত্নে সঞ্জয় তার ছবিকে ‘ভি এফ এক্স’ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। যুদ্ধের দৃশ্যে ‘ভি এফ এক্স’–এর ব্যবহার আছে ঠিকই, তবে তা একেবারে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এবং চূড়ান্ত মুহূর্তে। গত এক যুগ ধরে এ ছবি বানানোর কথা ভেবে গেছেন সঞ্জয়। পুরো তিন বছর সময় নিয়ে ছবি বানিয়েছেন, সেই ধৈর্য আর পরিকল্পিত পদক্ষেপের ছাপ গোটা ছবি জুড়ে ছড়িয়ে।
ছবির দৃশ্যরূপের এই ‘ক্লাসিকতা’ কিন্তু সারাক্ষণই এ ছবিকে শুধু দেখারই করে রাখেনি। সঞ্জয় লীলা বনশালির সম্পর্কে এটা বেশ চেনা অভিযোগ যে সঞ্জয় দর্শকের চোখেকেই সারাক্ষণ ‘গ্রেপ্তার’ করে রাখেন, মগজকে বেশি ভাবার পরিশ্রম করতে দেন না। তা তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ‘দেবদাস’ই করুন বা ডস্টয়েভস্কি ভেঙে ‘সাওয়ারিয়া’ করুন, কিংবা করুন শেক্সপিয়ার অবলম্বনে ‘রামলীলা’— সর্বত্রই তার সিনেমা মূলত দেখার।
এবার কিন্তু তিনি নিজেকে সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন। এবং তা পেরেছেন চিত্রনাট্যগত কারণেই। এবারও তিনি চিত্রনাট্যে শেক্সপিয়ারের একটি নাটকের আদলকে অংশত ব্যবহার করেছেন। সে নাকি ‘জুলিয়াস সিজার’। বীর সিজারের যুদ্ধজয় একদিকে সিজারকে করে তুলছে জননায়ক, তার আহূত অর্থ আর উপঢৌকনে ভরে উঠছে রাজকোষ; অন্যদিকে সেই যুদ্ধ থেকে সিজারের জীবনে আসা দ্বিতীয় নারী (ক্লিওপেট্রা) এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অন্দরের অসন্তোষ এই ‘প্লট’কে অসামান্য ভাবে প্রতিস্থাপন করেছেন সঞ্জয় মারান্না যোদ্ধা পেশোয়া প্রথম বাজিরাও বা বাজিরাও বল্লারের (রণবীর সিং) কাহিনীতে, তার এ ছবির মূল ভরকেন্দ্র এন এস ইমামদারের লেখা জনপ্রিয় মারানি উপন্যাস ‘রাউ’।
তার সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা ‘অ্যানকডোটস’ আর ‘জুলিয়াস সিজার’–এর আংশিক গড়নকে ব্যবহার করে সঞ্জয় তৈরি করে নিয়েছেন এ ছবির চিত্রনাট্য। বলেই নিয়েছেন ছবির শুরুতে, নিছক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ছবির নির্মাণ নয় এবং চিত্রনাট্য দ্বিধাহীন ভাবেই আমর্ম রাজনৈতিক। এতটা রাজনীতি বলিউডের ‘পিরিয়ড পিস’ এ যাবৎ আসেনি। সেই রাজনীতির বুনোটে যেমন একদিকে আছে মুঘল–রাজপুত–নিজাম–মারাঠাদের নিজস্ব দ্বন্দের মানচিত্র, তেমনই আছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অসারত্বের উল্লেখও। যা ‘সাব–টেক্সট‘–এ আজকের ভারতবর্ষেও এ ছবিকে প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। সবদিক থেকেই সঞ্জয় লীলা বনশালির পরিচালক জীবনে এ এক মোড় বদলের ছবি। সবদিক থেকেই বলিউডি পিরিয়ড পিস্–এ এক নতুন অধ্যায়।
এ ছবিতে ‘মুঘল–ই–আজম’ ঘরানায় শীর্ষমহল আছে, অন্দরমহলের রাজনীতি আছে, ‘যোধা–আকবর’–এর ঘরানায় যুদ্ধক্ষেত্র ও প্রেম আছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় সঞ্জয় সেন ওইসব ছবির মধ্যে দিয়ে একটি ‘ডিট্যুর’ করছেন, কিন্তু এক সময় তিনি সেগুলোকে ছাড়িয়ে অন্যত্র চলেও যান। আর তা যান রাজনীতি সূত্রেই। রাজনীতির স্বার্থেই। বুন্দেলখন্দের রাজা ছত্রশাল মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে সাহায্য চায় রাজিরাও বল্লারের। মারাঠা আরপতি ছত্রপতি সাহুর (শিবাজির নাতি) প্রধান অঙ্গাধিপতি রাজিরাও–এর কাছে এ প্রস্তাব বহন করে আনে ছত্রশালের বীর কন্যা মস্তানি।
ছত্রশাল হিন্দু রাজা হলেও, মস্তানি তার মুসলমান উপপত্নীর কন্যা। যুদ্ধে মস্তানি আর বাজিরাওয়ের বীরত্ব মুগ্ধ করে একে–অপরকে। প্রথাগত বিবাহ না হলেও, বুন্দেলখন্দে রাজপুত প্রথা অনুসারেই বাজিরাওয়ের অস্ত্রের সঙ্গে বিবাহ হয় মস্তানির (দীপিকা পাড়ুকোন)। যুদ্ধফেরত মহারাষ্ট্রে নিজের দুর্গ শনিবারওয়াড়ায় যখন ফেরে বাজিরাও, তখন নানা উপঢৌকনের সঙ্গে বুন্দেলখন্দ থেকে আসে মস্তানিও। বাজিরাওয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীর দাবি নিয়ে।
আর এখান থেকেই শুরু হয় মূল সঙ্ঘাত, যার সূত্রপাত অন্দরমহল দিয়ে। বাজিরাওয়ের প্রথম স্ত্রী কাশীবাই (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) বর্তমান থাকায়, মস্তানিকে মেনে নিতে পারে না কাশীবাইয়ের মা রাধাবাই (তনভি আজমি) আর ভাই চিমাজি। নানাভাবে তারা পর্যুদস্ত করে মস্তানিকে। স্বামীর প্রতি ভালবাসায় এই চক্রান্তের যোগ দেয় না কাশীবাঈ। কিন্তু এবার ঝড় ওঠে বাইরে। কারণ পেশওয়া যুদ্ধ করছে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে। অথচ সে বিয়ে করেছে এক মুসলমান রমণীকে।
বাজিরাও বুঝতে পারে, অদ্ভুত এক পরিহাসের মধ্যে ঢুকে গেছে তার নিয়তি। তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এই ঘেরাটোপকে বিনষ্ট করতে। এ ছবির একমাত্র দুর্বলতা হঠাৎই ‘ক্লাইম্যাক্স’–এর ঘনিয়ে আসা। এত বড় একটা ‘ট্র্যাজেডি’–র অন্তে আরেকটু সময় দাবি করছিল শেষ অধ্যায়। জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা করেছেন রণবীর সিং। বাচিক এবং শারীরিক অভিনয় উভয়তই তিনি অনবদ্য। দীপিকা নামভূমিকায় যথারীতি বাঘিনী। তবে চিত্রনাট্যের সবটুকু সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও এ ছবিতে তার সমান–সমান। কুটিল চরিত্রে চমকে দিয়েছেন তনভি আজমিও।
২৭ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস