বাংলা ছবি বিনিময়ে জট কাটছে দুই বাংলায়!
ঋজু বসু : সেই ‘ভাগের মা’য়ের গল্প। ভাঙন ধরা পরিবারে ভাগের মাকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের টানাপড়েনের করুণ চিত্রনাট্য সেলুলয়েডে আকছার বক্স-অফিস মাত করেছে।
ভাগ হওয়া বাঙালি দর্শককে নিয়ে কিন্তু ছবির প্রযোজক-পরিচালকদের হতাশার অন্ত নেই। এ-পার বাংলার ছবি সচরাচর রাজ্যের বাইরে দেখার সুযোগ মেলে না। ও-পারের ছবিরও এ-পারে ঢোকা কার্যত নিষেধ। ভাল বাংলা ছবি দেখার পথে রাজনীতি-কূটনীতির অদৃশ্য দেওয়ালটাই যেন সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি। টালিগঞ্জের তা-বড় তারকা থেকে পরিচালক-প্রযোজককুল, কথায়-কথায় এই নিয়ে আক্ষেপ করে থাকেন।
ও-পার বাংলার প্রভাবশালী মহল থেকে সিনেমারসিক আমনাগরিকের আক্ষেপটাও কম নয়। বছরে অন্তত এক-দু’বার কলকাতায় বেড়াতে এলে চট্টগ্রামের ফারহানা-রকিবুলদের মেনুতে একটি কি দু’টি বাংলা ছবি থাকবেই। ‘ব্যোমকেশ-‘ফেলুদা’ থেকে অপর্ণা সেন, কৌশিক-সৃজিত-শিবপ্রসাদদের ছবি যখন যেটা মেলে, কলকাতায় এলেই গোগ্রাসে গেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন তাঁরা। বছর তিনেক আগে এ শহরে বণিকসভা ফিকি-র অনু্ষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বসে বাংলাদেশের তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পর্যন্ত উদ্বেল হয়েছিলেন। কৈশোরে ঢাকার ‘বলাকা’ প্রেক্ষাগৃহে ‘অপুর সংসার’ দেখার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর।
গত শতকের ষাটের দশকের মাঝপর্ব অবধি ও-পার বাংলায় কলকাতা বা মুম্বইয়ের ছবি দেখা যেত অবাধেই। ’৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের পরে পরিস্থিতি পাল্টায়। ক্রমশ ঢের জল গড়িয়েছে পদ্মায়-গঙ্গায়। ‘অপুর সংসার’-এর ‘অপু’ সৌমিত্র এখন পক্ককেশ পোড়খাওয়া অভিনেতা। কিন্তু দু’দেশের সিনেমাহলে পরস্পরের মুখ দেখাদেখি এখনও কার্যত বন্ধ। ইলিশ-জামদানি বা চা নিয়ে দুই বাংলার কূটনীতি বা কুটুম্বিতা তা-ও নরমে-গরমে ওঠানামা করে। সিনেমার ক্ষেত্রটিতে খড়ির দাগের বিভাজনটাই শেষ কথা। কলকাতার ছবি এ-দেশে, আর ঢাকার ছবি ও-দেশে সীমিত গন্ডিতে আটকে থাকাই দস্তুর। আসন্ন ভাষা-দিবসের প্রাক্কালে সেই ছবিটাই পাল্টাতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘বেলাশেষে’ ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহি-খুলনা-বরিশালে বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পেতে চলেছে। একই সময়ে কলকাতা ও আশপাশের হলে আসবে ও-পার বাংলার সাম্প্রতিক জনপ্রিয় ছবি আরিফিন শুভ-জাকিয়া বারি মম জুটির ‘ছুঁয়ে দিলে মন’।
বাংলাদেশের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী ইনু সাহেব এই উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দু’দেশে ছবি রিলিজের ক্ষেত্রে আইনি জট এখনও আছে। কিন্তু আইনের ভিতরে কিছু জানলাও খোলা। সেগুলিকে দু’দেশের চলচ্চিত্র স্রষ্টাদেরই কাজে লাগানো উচিত।’’ এ যাত্রা, ভারত-বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত আইন কাজে লাগিয়ে বিনিময়ের ভিত্তিতে দুই বাংলার দু’টি ছবিকে দু’দেশে দেখানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। এর জন্য দু’দেশ থেকেই আলাদা করে ছবি দু’টির সেন্সরের ছাড়পত্র জোগাড় করা হয়েছে।
‘‘আমার কাছে এটা স্বপ্ন সফল হওয়া! এতে আমাদের দু’দেশের ছবিই অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’’— বলছেন টালিগঞ্জের অভিভাবকপ্রতিম তারকা প্রসেনজিৎ। বছর দুয়েক আগে এই বাংলার ছবির জন্য দরবার করতে পরিচালক গৌতম ঘোষ, প্রযোজক মণি, বিজয় খেমকা প্রমুখের সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। গৌতম ঘোষও দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে ছবি নির্মাণের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে জড়িত। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ‘মনের মানুষ’-এর পরিচালকের পরের ছবি ‘শঙ্খচিল’ও দু’দেশের ‘কো-প্রোডাকশন’। গৌতমের কথায়, ‘‘দু’দেশের যৌথ ছবি-র ক্ষেত্রে একসঙ্গে দুই বাংলায় রিলিজ এখন মসৃণ হয়েছে। কিন্তু যে কোনও ভাল বাংলা ছবি দুই বাংলায় দেখানো না-গেলে ছবির বাণিজ্য থমকে যাবে।’’
বাস্তবিক, বাজারের যা হাল, টালিগঞ্জের ছবির বাজেট এক কোটি, সওয়া কোটি ছাড়ালেও দুশ্চিন্তায় প্রযোজকের রাতের ঘুম মাটি হয়। ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, এ-পারে ছবির বাজেট দেড়-দু’কোটির বেশি হলে প্রযোজকের পক্ষে টাকা তোলাটাই কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রযোজক কৌস্তুভ রায় থেকে পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী সকলেই এক মত, বাজারের পরিধি না-বাড়লে এর বেশি কিছু করা যাবে না। এই বাংলায় মেরে-কেটে ২০-২৫টি মাল্টিপ্লেক্স। মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন শহর মিলিয়ে এর সংখ্যা ১০০-র কাছাকাছি। এ রাজ্যে হলের সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০-য় এসে ঠেকেছে। অন্ধ্রে হলের সংখ্যা, এর দশগুণ। তা ছাড়া, মহারাষ্ট্রে মরাঠি ছবির মতো বিপুল করছাড় বা হলে ‘প্রাইম টাইমে’ দেখানোর সুবিধাও এ রাজ্যে সুলভ নয়। ফলে, হিট তেলুগু বা মরাঠি ছবি যেখানে অনায়াসে ২৫ কোটির শৃঙ্গ ছোঁওয়ার কথা ভাবতে পারে, বাংলা ছবির ব্যবসা তিন-চার কোটি ছুঁলেই তা প্রায় লটারি জেতার সামিল।
ও-পার বাংলার ছবিটাও খুব আলাদা নয়। ঢাকার ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, বাংলাদেশেও ভাল হল হাতে গোনা। বাংলাদেশি মুদ্রায় ছবির বাজেট ৮০ লক্ষ ছাড়ালেই সেখানেও প্রযোজকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর সহ-প্রযোজক তাহসিন সঈদ কবুল করছেন, ‘‘সুপারস্টার শাকিব খানের ছবি ছাড়া বাংলাদেশের সিনেমা দু’-আড়াই কোটির বেশি ব্যবসা করছে, তা প্রায় অভাবনীয়।’’
অথচ, সংখ্যার নিরীখে বাংলাভাষাভাষীরা বিশ্বের ছ’নম্বর জনগোষ্ঠী। এ-পার বাংলায় ১০ কোটি, বাংলাদেশে ১৬ কোটি বাঙালি রয়েছেন। অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে শুরু করে বিলেত-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ ধরলে আরও পাঁচ-ছ’কোটি বাংলাভাষী রয়েছেন। বলিউডি ছবির নামজাদা আন্তর্জাতিক পরিবেশক ইরোজ ফিল্মসের কর্তা নন্দু আহুজা আবার বলছেন, ‘‘ভাল ছবির ক্ষেত্রে ভাষাটাও বাধা নয়। ‘বেলাশেষে’ বা কয়েক বছর আগের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর মতো কিছু বাংলা ছবি প্রমাণ করেছে ঠিকঠাক প্রচার পেলে অবাঙালিরাও তা দেখতে যাবেন।’’
এমনিতেও টালিগঞ্জের ছবির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ছবি বিদেশে রিলিজ না-করা গেলেও বিলেত-আমেরিকা কি বাংলাদেশে চোরা প্রিন্ট ঠিক পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাতে বেশি লোকে ছবি দেখলেও, ব্যবসার সুফল প্রযোজকের ঘরে ঢুকছে না। বলিউডের ছবির ঢঙে বাংলা ছবির ক্ষেত্রেও একযোগে ‘অল ইন্ডিয়া’ বা ‘ওয়র্ল্ড রিলিজ’টাও তা-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এখনই সেটা করা যাচ্ছে না! তবে পণ্য আমদানি-রফতানির নিয়মে দু’দেশের দু’টি হিট ছবি দুই বাংলায় পৌঁছে দেওয়াও কম কথা নয়, মানছেন দু’দেশের ইন্ডাস্ট্রির লোকজনই। টালিগঞ্জের অভিজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, যা হোক, তা হোক করে বিদেশে ছবি রিলিজের মানে হয় না। এর আগে বিগবাজেট ছবি ‘চাঁদের পাহাড়’-আমেরিকায় কয়েকটি হলে রিলিজ করলেও দারুণ কিছু সাড়া মেলেনি। ঢাকায় বলিউডের কয়েকটি ছবি মুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের একটি ছবিও কলকাতার অকিঞ্চিৎকর একটি হলে রিলিজ করা হয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। এ যাত্রা ছবি বিনিময়ের উদ্যোগটির সঙ্গে জড়িত জিরোনা এন্টারমেন্ট সংস্থার কর্ণধার শুভজিৎ ঘোষ কিন্তু আটঘাট বেঁধে এগোচ্ছেন। টালিগঞ্জে গত বছরের সব থেকে হিট ছবি ‘বেলাশেষে’ বাংলাদেশে গোটা দশেক শহুরে হলে দেখানোর ছক কষা হয়েছে। মাথায় রাখা হয়েছে, মধ্যবিত্ত পারিবারিক পরিমণ্ডলে ছবিটি ভাল সাড়া ফেলেছিল। আর বাংলাদেশের ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর জন্যও এই বাংলার অভিজ্ঞ পরিবেশক পিয়ালি ফিল্মসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছে। ছবিটির জন্য কলকাতা ও আশপাশের ১০-১৫টি হল বেছে নেওয়া হয়েছে। একই তারিখে ঢাকা-কলকাতায় দু’টি ছবির মুক্তির চেষ্টা চলছে।
এখানেই শেষ নয়। শুভজিৎদের উদ্যোগে এর পরে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘নাটকের মতো’ ছবিটিরও বাংলাদেশে ‘রিলিজ’ প্রায় পাকা হতে চলেছে। বিনিময়ে শাকিব খানের কোনও হিট ছবি দেখার সুযোগ পাবেন, এই বাংলার মানুষ। টালিগঞ্জের তরুণ প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসানের মতে, ‘‘দুই বাংলারই যাতে ভাল হয়, সেটা দেখতে হবে। আর টলিউডের কম বাজেটের ভাল ছবির বাজারটা আর একটু বাড়িয়ে তুলতে পারলে তো খুবই ভাল হবে।’’
ছবি নিয়ে দুই বাংলার এই বেরাদরির সবটাই অবশ্য নিখাদ সম্প্রীতির হাওয়া নয়। এই বাংলার ছবি ঢুকে ও-পার বাংলার ছবির ব্যবসার ক্ষতি করবে, এমন আশঙ্কাও ঢাকার ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে রয়েছে। তবে মন্ত্রী ইনুসাহেব মনে করেন, ‘‘টালিগঞ্জের ছবির দরজা খুললে তা আখেরে বাংলাদেশের ছবির মান বাড়াতেও সাহায্য করবে।’’ পরিচালক গৌতম ঘোষও বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ছবি এই বাংলায় চেনাতেও টালিগঞ্জকে নিজেদের স্বার্থেই বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে।’’
সকলেই সার বুঝেছেন, দর্শক ভাগাভাগি ঠেকানো না-গেলে বাংলা ছবির গঙ্গাপ্রাপ্তি ঠেকানো যাবে না! -আনন্দবাজার
২৯ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস