কেমন গেলো ২০১৫ সালের ঢাকাই সিনেমা?
রেদওয়ান রনি : নানান চড়াই-উতরাই পার হয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকে দুর্দান্ত সব প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা, আর দেশীয় চলচ্চিত্রের বাজার চাঙা করতে একের পর এক নানান কায়দায় চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রবল উৎসাহে। ২০১৫ ছিল প্রস্তুতির বছর আর ২০১৬ সাল বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার বছর। ২০১৫ সালে দেশের চলচ্চিত্রের বাজার চাঙা করার চেষ্টা ছিল নানামুখী। বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে বেগবান করার উদ্দেশ্যে অনিমেষ আইচ ও শিহাব শাহীনের প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র দুটি ছিল চোখে পড়ার মতো। সাইকো-কিলার ধরনের জিরো ডিগ্রি দেশীয় বাজারে ঢুকে সাধারণ দর্শককে টান টান উত্তেজনা দেওয়ার চেষ্টা করে। এদিক দিয়ে ছুঁয়ে দিলে মন প্রায় শতভাগ সফল দর্শককে হলে টানতে, দীর্ঘদিনের একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া কাহিনি দিয়েও বিনোদনকে পুঁজি করে এগিয়ে গিয়েছেন শিহাব শাহীন।
টিভি পর্দার জনপ্রিয় দুই নায়কের প্রথমবারের মতো উপস্থিতি ছিল বড় পর্দায়। সজল রানআউট এবং অপূর্ব গ্যাংস্টার রিটার্ন-এ। তবে পুরোনো দাপট নিয়ে শাকিব খানই দেশীয় বাজার গরম রেখেছেন মাঝেমধ্যে। ভালোভাবেই উঠে আসার চেষ্টা করেছেন আরিফিন শুভ, সেই সঙ্গে চেষ্টা ছিল বাপ্পি আর সাইমনের।
নায়িকাদের দাপটও বেশ ভালোই লক্ষণীয় এ বছরে। নায়িকানির্ভর ছবি অগ্নি টুতে মাহিয়া মাহি সফল, পদ্মপাতার জল ছবিতে সফল বিদ্যা সিনহা মিম। ববি ও অপু বিশ্বাসের উপস্থিতি ছিল বরাবরেই মতোই। পরীমনি, প্রথম ছবি মুক্তির আগেই প্রায় অর্ধশত ছবির পাইপলাইন নিয়ে বেশ গুঞ্জন ছিল চলচ্চিত্রপাড়ায়। সম্ভাবনা তাঁর যথেষ্টই প্রবল। নায়লা নাঈমকে বাজার চাঙা করতে অনেকে ব্যবহার করেছে ‘স্পাইস’ হিসেবে। দর্শক তাঁকে কতটুকু গ্রহণ করেছেন, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তবে অধিক ট্রেলারের চাকচিক্যে সিনেমা হলে ঢুকে একেবারেই মানহীন ছবি নিয়ে হতাশও হয়েছেন কিছু দর্শক। ট্রেলারে চাকচিক্য থাকা দরকার। সেই সঙ্গে মনে করি, গল্পটাও ঠিকঠাক বলার চর্চা আমাদের বেশি থাকা দরকার।
আরেকটা ব্যাপারে একটু নজরদারি আমাদের আরেক ধাপ এগিয়ে দিতে পারে, যৌথ প্রতারণার ছবি না হয়ে যেন ঠিকঠাক যৌথ প্রযোজনার ছবি হয়।
২০১৫ সালে সবচেয়ে বড় অর্জন আমি মনে করি, বিশ্ব চলচ্চিত্রে আমাদের অবস্থান জানান দেওয়া যে আমরা তৈরি হচ্ছি বেশ ভালোভাবেই। বলতে চাই জালালের গল্প ছবির কথা। আবু শাহেদ ইমনের প্রথম এই ছবি দিয়েই বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে অর্জন করেছি বেশ কিছু সাফল্য। মৌসুমী হামিদ, শর্মিমালাসহ অন্য শিল্পীদের অভিনয় ছিল চোখে পড়ার মতো। মোশাররফ করিমের অনবদ্য অভিনয় দিয়ে আমরা অর্জন করেছি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরস্কারও। একদমই দেশীয় মৌলিক গল্পের এই ছবির গল্প বলার নতুনত্ব স্বস্তি দিয়েছে সিনেমা হলের দর্শককেও।
সুতপার ঠিকানা, বাপজানের বায়োস্কোপ, গাড়িওয়ালা, ঘাসফুলসহ আরও কিছু চলচ্চিত্রের চেষ্টা ছিল দর্শককে ভালো গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার। লালচর, অনিল বাগচীর একদিন আর ভারতে আসিফের শর্টফিল্মের জয় পেয়েছি বছরের শেষ ভাগে।
২০১৬ হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অফুরন্ত সম্ভাবনার বছর। আকাঙ্ক্ষিত কয়েকজন প্রতিভাবান নির্মাতার চলচ্চিত্র আসতে যাচ্ছে নতুন বছরে। এই ছবিগুলোই আমাদের মূলধারার সিনেমার নতুন প্যাটার্ন তৈরি করবে, উন্মোচন করবে নতুন দিনের নতুন বাজার তৈরির সব সম্ভাবনা। প্রতিভাবান বিজ্ঞাপন ও ফিকশন নির্মাতা অমিতাভ রেজার প্রথম ছবি আয়নাবাজি আসছে বছরের মাঝামাঝি। ঢাকা অ্যাটাক-এর মাধ্যমে অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে ছোট পর্দার আরেক অভিজ্ঞ নির্মাতা দীপংকর দীপনের। অভিষেক হচ্ছে নির্মাতা ওয়াহিদ তারিক, আশুতোষ সুজন, ইফতেখার আহমেদ ফাহমিসহ আরও কয়েকজন নির্মাতার।
জোর প্রস্তুতি চলছে বাণিজ্যিক ছবির আঙিনাতেও। শাকিব খান নতুন সাজে আসছেন সম্রাট-এ, তিশা-শাকিব খানের নতুন জুটি আসছে মেন্টাল-এ। আলোচিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী ২ আসছে এ বছরেই। নির্মাতার পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন মুখেরও অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে ২০১৬ সালেই, আয়নাবাজিতে নাবিলা, আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র আইসক্রিম-এর প্রধান তিনটি চরিত্রে রাজ, তুষি, উদয় এবং ভয়ংকর সুন্দর ছবিতে আশনা হাবিব ভাবনার।
ইতিমধ্যে দর্শকের ভালোবাসা পাওয়া প্রতিভাবান নির্মাতাদের পরবর্তী ছবিগুলো নতুন বছরে বক্স অফিস কাঁপানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনেও আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়ে দেবে—এ কথা হলফ করে বলতে পারি। শোনা যাচ্ছে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন বেশ কয়েক দেশের মিলিত প্রযোজনায় আন্তর্জাতিক একটি চলচ্চিত্র, সেটা যে কতটা চমৎকার একটা ব্যাপার হবে আমাদের নতুন নির্মাতাদের জন্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে, তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। মনপুরাখ্যাত গিয়াস উদ্দিন সেলিম তৈরি করবেন নতুন ছবি। আসছে অনিমেষ আইচ, তৌকীর আহমেদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কামার আহমেদ সাইমনসহ অনেক অভিজ্ঞ নির্মাতার ছবি।
এই যে নতুন সম্ভাবনার জোয়ার, তা আমাদের ধরে রাখতে হবে ঠিকঠাক করে। আমাদের রয়েছে প্রতিভাবান নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী, ভালো সিনেমার দর্শক সবই, দরকার শুধু বাণিজ্যিক কাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে ছোট্ট একটু পৃষ্ঠপোষকতার। আমি খুবই অবাক হই পাশের দেশের অনেক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনার এই চলচ্চিত্রশিল্পে লগ্নি করার জন্য ঘুরঘুর করছে, মিটিং-সিটিং করছে, তাহলে আমাদের দেশীয় বড় উদ্যোক্তারা কেন এগিয়ে আসছেন না সেভাবে? কর্মী প্রস্তুত, প্রস্তুত কাঁচামাল ও ক্রেতাও, শুধু মেশিনের অভাবে একটা শিল্প দাঁড়াবে না, এটা আমি বিশ্বাসই করি না। প্রতিটি জেলা ও থানায় সঠিক ডিজিটাল প্রজেকশনসহ ভালো পরিবেশের একটা করে সিনেমা হল, ডিজিটাল টিকিটিং, ডিস্ট্রিবিউশনের আধুনিকায়ন আর ভালো কয়েকটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, ব্যস! এই পৃষ্ঠপোষকতাটুকুতে অনেক বড় সম্ভাবনাময় একটা চলচ্চিত্র বাজার তৈরি হতে পারে।
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? নতুন বছর সামনে রেখে নির্মাতারা জেগে উঠেছেন। শিল্পী-কলাকুশলীরা জেগে উঠেছেন, দর্শকেরাও জেগে উঠেছেন; সঙ্গে উদ্যোক্তারাও একটু জেগে উঠলেই সোনায় সোহাগা। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প এই বছরে সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে পৌঁছাবে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের বাজার অবশ্যই অবাক হয়ে দেখবে, বাংলাদেশ আসছে।-প্রথম অালো থেকে
৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন
�