বিনোদন ডেস্ক : পৃথিবীটা যদি স্বপ্নের দেশ হত, তবে সে স্বপ্নের দেশের রাজরানি যে কে হতেন তা বাঙালিমাত্রই জানে। তাঁর পাখির নীড়ের মতো চোখের আশ্রয় আছে বলেই তো বাঙালির বিশ্বাস নীড় ছোট হলেও ক্ষতি নেই, কল্পনার আকাশ চিরকালই বড়৷ সে সাদা কালো আকাশে রঙধনুর সাতরঙ ছড়িয়ে তিনি যখন বলেন ‘জান না কি তুমি কে, আমি কার’- বাঙালি তা জানার চেষ্টাও করে না৷ বাঙালিজীবনে এক সমাধানহীন অপার রহস্য হয়ে থেকে যান সুচিত্রা সেন৷
মহাকাল তাঁকে দিয়েছে বাঙালির মহানায়িকার আসন৷ তবু সে আসনও যেন তাঁকে ধরতে পারে না৷ আসনের পরিসীমা পেরিয়ে সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠেন এক রূপকথা৷ আসলে সেই সাদা কালো দিনে তিনিই তো ছিলেন বাঙালি সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার গোপন অহংকার৷ সেদিন সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা দেশভাগে ক্লিষ্ট বাঙালিকে কী দিয়েছে না দিয়েছে, সে সবের জটিল রাজনৈতিক হিসেব ভুলতে চাওয়ার ইচ্ছে প্রশ্রয় পেত তাঁর নিষ্পাপ চাহনিতে৷ পরিবর্তে সেই সদ্য স্বাধীন দেশের এক প্রদেশে যে স্বপ্নের কুঁড়ি পাপড়ি মেলছে, সবকিছু ভালো হওয়ার যে বাসনাকুসুম বিশ্বাসের শিশিরে স্নাত হয়ে প্রথম আলো দেখছে, বাঙালি যেন তার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিল তাঁর মুখচ্ছবিতেই৷ সিনেমা, বস্তুত যা বাস্তবকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বাস্তবিক স্পর্ধা, সেখানেই একটা জাতির চাওয়া-পাওয়ার গোপন ইস্তেহার প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল তাঁর মধ্যে৷ বলা ভালো তা হয়েছিল উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর সোনার জুটিতে৷ বস্তুত বাঙালির হারানো সুরের ধরতাইটি যেন দিয়ে গিয়েছিল এই জুটি৷ ফলত রক্তমাংসের শরীর থেকে, সিনেমার পর্দা থেকে, সাদা কালো বাস্তবতা থেকে সুচিত্রা সেন ছড়িয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসের পরিসীমায়৷ যেখানে তিনি নিজেই সময়ের প্রচ্ছদ৷
‘আজ দু’জনে মন্দ হলে মন্দ কী’ যে কোনও সময়ের যৌবনের স্পর্ধা এ কথা সাহস করে বলেত চায়৷ তবে সমাজ যখন গুরুজনের মোটা চশমার কাঁচের কড়া নজরের নীচে, হাজারো বিধিনিষেধের সামাজিক কাঠামো যখন যৌবনকে এ অনুমতি দিতে নারাজ, তখনই বাস্তবের বাইরে আর এক সমান্তরাল বাস্তবতায় যদি সে কথা শোনা যায়, তবে তাইই হয়ে ওঠে সম্মিলিতে অনুচ্চারিত কণ্ঠস্বর৷ পাঁচ থেকে সাতের দশকের বাঙালি সমাজের যুবক-যুবতীর এই স্বপ্নপূরণের ছাড়পত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সুচিত্রা৷ তাঁর আবেদন তাই প্রেমের মতোই চিরকালীন, শাশ্বত৷
স্বাধীনতার সময়কালে বাংলা তথা সারা দেশ দেখেছে মহিয়সী নারীদের৷ স্বাধীনতা পরবর্তীতে রমণীর সে রূপটি কেমন হবে, সময় নিশ্চিত সে পরীক্ষায় রত ছিল৷ সুচিত্রা সেন উঠে এলেন সে প্রশ্নপত্রের উত্তর হয়ে৷ তাঁর চরিত্রদের মধ্যে দিয়েই ধরা পড়ল বাঙালির সেই কাঙ্খিত নারী৷ চিরন্তন বাঙালি রমমীর মূল্যবোধকে আঁচলচাবি করে নিয়েই যিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন নিজের অধিকার৷ ‘হারানো সুর’-এর রমা যখন নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, কিংবা ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন যখন প্রেম এবং ধর্মবিশ্বাসের মধ্যিখানে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেয়, বাঙালি চিনে নিতে পারে সময়ের কষ্ঠিপাথরে পরিক্ষীতি সঠিক রমণীটিকে৷ সেই আর্কিটাইপ্যাল নারী অমরত্বকে ছুঁয়ে নজরকাজল পরিয়ে দেন ইতিহাসের কপালে৷
বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রির কাঁচা মেঠোপথটিকে যে রূপ দিতে চেয়েছিলেন একদা কাননদেবী, তাই বাঁধানো রাজপথ হয়ে ওঠে সুচিত্রা সেনের পেশাদারিত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তায়৷
ছবির ইতিহাস থেকে সামাজিক পাঁচালি, প্রেম থেকে স্বপ্ন, বাসনা থেকে বাসনাপূরণে তাই সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠেন প্রায় অলৌকিক এক আচ্ছন্নতা৷ নশ্বর সময় ফুরিয়ে যায়৷ তবু তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আজও বাঙালি বলতে ভালোবাসে-তুমি না হয় রহিতে কাছে, আরও কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে…৷ -কলকাতা২৪
১৭ জানুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস