রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬, ১২:২৪:৩৬

অন্ধ পরিবারটি কাঁদালো সবাইকে, কাঁদলেন হানিফ সংকেতও

অন্ধ পরিবারটি কাঁদালো সবাইকে, কাঁদলেন হানিফ সংকেতও

মোশাররফ রুমী : একসময় বলা হতো টেলিভিশন একটি শক্তিশালী মাধ্যম। পরে মোস্তফা মনোয়ার সেই ধারণা ভেঙে  দেন। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশন নয় ব্যক্তি যদি শক্তিশালী হয় তবে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়’। কথাটা যে বড় সত্যি তার প্রমাণ তিন দশক ধরে দিয়ে যাচ্ছেন নন্দিত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত তার দর্শকধন্য অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে।

একে একে ২৬টি বছর পার করে গত ২৯শে জানুয়ারি প্রচারিত পর্বের মাধ্যমে ‘ইত্যাদি’ পা  রেখেছে সাফল্যের ২৭ বছরে। এবার পল্লীকবির জন্মদিনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে তার বাড়ির সামনে আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠান ধারণের। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল ফরিদপুর ও পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীনের ওপর তথ্যবহুল প্রতিবেদন।

অনুষ্ঠান শুরু করা হয়েছিল পল্লীকবির সেই বিখ্যাত ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়’ কবিতাটি দিয়ে। অনেকেই এই কবিতাটি শুনে নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। হানিফ সংকেত স্বল্প পরিসরে পল্লীকবির যে গানগুলো শোনালেন, মনে হয় এ প্রজন্মই শুধু নয়-অনেক শিল্পীই এ গানগুলো যে পল্লীকবির তা জানেন না। পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে অসাধারণ লেগেছে জসীমউদ্‌দীনের লেখা বহুশ্রুত ‘আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে...’ গানটি। জসীমউদদীনের তিনটি গানের সমন্বয়ে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় নাচটি ছিল এককথায় অনবদ্য।

অনুষ্ঠানের নতুন সংযোজন এলাকাভিত্তিক নাচের ফলে ঢাকা শহরের কিছু চেনামুখের বাইরেও যে গ্রামেগঞ্জে প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছে তা যেমন জানা যায়, তেমনি ইত্যাদির মতো বিশাল একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে পেরে স্থানীয় শিল্পীরাও হন আনন্দিত। এবারের দর্শক পর্ব সাজানো হয়েছিল জসীমউদদীনের লেখা, ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে...’, ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে...’, ‘ও বন্ধু রঙিলা রঙিলা রঙিলারে...’, ‘আমার হাড় কালা করলাম রে...’,  এই গানগুলো দিয়ে।

আর এতে অতিথি ছিলেন ফরিদপুরের সন্তান প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর এবং জসীমউদদীনের গানের অমর শিল্পী আবদুল আলীমের পুত্র জহীর আলীম।  তাদের অংশগ্রহণে দর্শক পর্বটি উপভোগ্য হয়েছে। ইত্যাদিতে আবারও বিদেশি পর্ব সংযুক্ত করায় হানিফ সংকেতকে ধন্যবাদ। এবারে বিদেশি পর্ব ছিল বিশ্বের দীর্ঘসময় ধরে চলমান নির্মাণ প্রকল্প সাগরাদা ফ্যামিলিয়ার ওপর।

১৩৪ বছর ধরে এর নির্মাণকাজ চলছে, শেষ হবে ২০২৭ সালে। স্পেনের বার্সোলোনায় অবস্থিত চার্চ বা গির্জা সাগরাদা ফ্যামিলিয়া হচ্ছে পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এবং ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। আমরা অনেক আলোকিত মানুষের কথা বলি কিন্তু ইত্যাদিতে আলোকচিত্রী আবু তাহেরের প্রতিবেদন দেখে বোঝা গেল আলোকিত মানুষদের কাছেও আলোকিত মানুষ তিনি। ভালোবাসা দিয়ে তিনি তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন স্ন্নেহ। এতগুলো গুণী মানুষের স্নেহধন্য হওয়া মানুষটি এতদিন পর্দার আড়ালেই ছিলেন।

আর ‘ইত্যাদি’ সেই আড়ালে থাকা মানুষটিকেই আমাদের সামনে উপস্থাপন করলো। আবু তাহেরকে দেখে নিঃসঙ্গ বা একাকী থাকা বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত হবেন অনেকেই। অনুষ্ঠানের প্রতিটি নাট্যাংশই ছিল সময়োপযোগী। আসলে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান যে মানুষকে কতভাবে আন্দোলিত করতে পারে ‘ইত্যাদি’ তার বড় প্রমাণ। বরাবরের মতোই ইত্যাদির এবারের পর্বে সবচেয়ে মানবিক ও হৃদয়ছোঁয়া অংশ ছিল অন্ধ সংগীত পরিবারকে নিয়ে করা প্রতিবেদনটি।

একই পরিবারের উপার্জনক্ষম ৫ জন সদস্যসহ একটি মেয়ে এবং একমাত্র নাতনিটিও অন্ধ। পরিবারের প্রধান হেলাল মিয়া। অন্ধত্বের জন্য করুণার পাত্র না হয়ে এই পরিবার বেছে নিয়েছে সংগীতকে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পরিবারের সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টাউন হলের মুক্ত মঞ্চে গান করেন। হেলাল মিয়া বললেন, তাতে যা আয় হয় তাই দিয়ে তাদের সংসার চলে। কারণ তাদের কোনো বাড়তি চাহিদা নেই।

হানিফ সংকেতের অনুরোধে হেলাল মিয়ার পরিবারের সদস্যরা মিলে যখন ‘আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি...’ গানটি পরিবেশন করলেন-অনেক দর্শকই তখন চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। কেঁদেছেন দর্শক-কেঁদেছেন হানিফ সংকেত নিজেও। ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের সম্মান জানিয়ে শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে দুলাখ টাকাও দেয়া হয়। একটি টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ উপহার, দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এমনি প্রতিবেদন-ব্যাপক প্রশংসনীয় একটি বিষয়।

অনুষ্ঠানের শেষে হানিফ সংকেত বললেন, ‘ভিক্ষা নয়, চুরি নয়, দুর্নীতি নয়, কোনো অসৎ পথেও না এরা যে সম্মানবোধ থেকে ভিক্ষা না করে পরিশ্রম ও নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তাকে সম্মান জানাতেই হয়।’ তার কথায় প্রতিধ্বনি তুলে আমরাও বলি- ধন্যবাদ হানিফ সংকেত, স্যালুট সেই অন্ধ পরিবারকে, ধন্যবাদ কেয়া কসমেটিকসকে ইত্যাদির এ সামাজিক আন্দোলনকে চলমান রাখতে সহযোগিতা করে যাওয়ার জন্য। -মানবজমিন
৩১ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে