শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ১১:২১:১৭

দিতি, আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন সবার মাঝে

দিতি, আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন সবার মাঝে

ফরিদুর রেজা সাগর : পারভিন সুলতানা দিতি। অনেক মানুষের প্রিয় অভিনেত্রী- প্রিয় মানুষ, এ মুহূর্তে আমাদের অনেকের অপরিচিত হয়ে শুয়ে রয়েছেন হাসপাতালের কক্ষে। সাদা ধবধবে চাদরের বিছানায় শুয়ে থাকা দিতির বড় বড় চোখে এখন নানা রহস্য-বিস্ময়। যে কেউ তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালে তাকে চিনতে পারেন দিতি। তবে কিছুক্ষণ পরে আবার হারিয়ে যান নিজের জগতে।

দিতির সঙ্গে আমার আলাপ কবে? আসলে দিতির সঙ্গে সরাসরি আলাপ হওয়ার অনেক  আগে থেকেই দিতি আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। তার আগেই শিল্পী দিতির নানা ঘটনা, অভিনয় জীবনের অনেক কিছুর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গেছে।

দিতির সঙ্গে তারপর যখন সরাসরি আলাপ হলো, সেটা আনুষ্ঠানিক। এক সকালে ফোন করলেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বললাম চলে আসেন। অফিসে মুখোমুখি বসে সরাসরি বললেন, ‘আমি চ্যানেল আইয়ের জন্য নাটক তৈরি করতে চাই।’ হেসে বললাম, ‘খুব ভালো কথা। খুশিতে আটখানা দিতি বললেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল আপনি ফিরিয়ে দেবেন না।’

আমি বললাম, ‘আপনার সম্পর্কে আমরা অনেক দিন ধরে জানি। অভিনয় জগতে অনেক দিন আছেন। তাই আমার একটা ছোট অনুরোধ আছে।’
-‘সেটা কী?’

বললাম, ‘আমাদের জন্য যে নাটকটা তৈরি হবে, সেটা আপনার পরিচালিত প্রথম  নাটক হতে হবে। সবার আগে যদি আমাদের চ্যানেলের জন্য তা নির্মিত হয় তবে আমরা রাজি।’

দিতি প্রস্তাবটা পেয়ে আংশিক যেন ঘাবড়ে গেলেন। দুই সেকেন্ড নীরব থেকে জানালেন, ‘আমি কি পরিচালনা করতে পারবো?’

বললাম, ‘অভিনয় জগতে সুনাম নিয়ে আছেন অনেক দিন। অভিজ্ঞতার ঝুলি এতদিনে বেশ ভারি। চাইলেও খারাপ করবেন না, আমরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত।’

আত্মবিশ্বাসের ছায়া উঁকিঝুকি দিলো দিতির চেহারায়। আস্তে করে বললেন, ‘তাই।’

বললাম, ‘তা ছাড়া একটা সুবিধার দিক আছে। যেহেতু এটা আমাদের নিজেদের চ্যানেল, কারও মুখাপেক্ষী নই আমরা, সেহেতু নাটক বানানোর পরে যদি মনে করেন অনেক খারাপ হয়ে গেছে, আমরা প্রযোজনাটি অনএয়ারে দেবো না। সেই খরচের জন্য কাউকে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না।

দিতির লক্ষ্যযোগ্য দিকটা সেখানেই। খোলামেলা আহ্বান পেয়েও স্থির থাকলেন। অস্থিরতা দেখালেন না। বললেন, ‘আমি ভাববো। আমাকে ভাবতে দিন।’

ভাবতে সময় নিলেন দিতি ছয় মাস। ছয় মাস পরে দিতি আবার আমাদের কার্যালয়ে এসে জানালেন, ‘আমি রেডি। পরিচালনা করবো।’

‘খুব ভালো কথা। শুরু করে দিন।  আপনার প্রথম পরিচালনা। বাজেট নিয়ে আলোচনা সেকেন্ড ফ্যাক্টর।’

দিতি বললেন, ‌‘আসলে আমি একটা গল্পের কথা ভেবেছি।' দিতির কথা শুনে মনে মনে চিন্তা করলাম একটা ব্যাপার। ‘যে মেয়ে মনপছন্দ গল্প ঠিক করতে ছয় মাস সময় নেয়, ব্যক্তিজীবনে সেই স্থিত মেয়েটি যথেষ্ট গোছানো নিশ্চয়ই! চিন্তা করেছেন। ভাবনা করেছেন। সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব বোধ করেছেন। সুযোগ আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়েননি। সুতরাং এ কাজটি ভালো না হয়ে যাবে কোথায়!’

একটু পিছনে ফিরে গেলাম। এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে।’ এখন আমরা প্রাইভেট চ্যানেলে অনেক রিয়েলিটি শো’র আয়োজন করি। প্রচার করি। বাহবা পাই। কিন্তু এফডিসি সেদিন যে বিজ্ঞাপনটা দেয় তখন টিভিতে ‘নতুনকুঁড়ি’ ছাড়া আর কোনো রিয়েলিটি শো’র কথা আমার মনে পড়ে না।

সেই আয়োজন থেকে বেরিয়েছেন মান্নার মতো অভিনেতা। বেরিয়েছেন পারভিন সুলতানা দিতি। মফঃস্বলের মেয়ে। সোনারগাঁ এলাকায় থাকেন। প্রায় গ্রাম। সেখান থেকে ঢাকা এসে পড়াশোনা করছেন। করছেন সিনেমায় অভিনয়। সেই দিতির সংবাদ পত্রিকায় আসায় আমাদের দৃষ্টি ছিল আর সবার মতো ওর দিকেও।

শুধু সিনেমার জগত নয়। বিটিভির প্রযোজক ফখরুল আবেদিন দুলাল ওকে নিয়ে করলেন লাইলী মজনু। লাইলী চরিত্র করবার জন্য তিনি খুঁজছিলেন এমন একটি মেধাবী মুখ। প্রথম নাটকেই বিশাল সাড়া। সেই সময়টায় আমি বিটিভির নানা অনুষ্ঠানে জড়িত। তাই অনেক কাছের মানুষ আমাকে ফোন করলেন। ‘ভাই, ওই মেয়েটিকে আমার অমুক বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল হিসেবে নিতে চাই। একটু যোগাযোগ করিয়ে দেয়া কি সম্ভব’?

সেই সময়ে আমরা দেখলাম, অনেক শাড়ির দোকানে প্রচুর শাড়ির বিজ্ঞাপনের মডেল হলেন দিতি। ঢাকা শহর কেবল নয়, চট্টগ্রামের একটি শাড়ির দোকানের মডেল হলেন দিতি। প্রথম এসেই সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপন সর্বত্রই আলোচনায়। পরবর্তীতে সংগীতশিল্পী হিসেবেও আলোচিত।

প্রস্তাব পাওয়ার পরও ছয় মাস সময় নিয়ে যে দিতি কাজ শুরু করেছিলেন, বলা বাহুল্য, তার পরিচালিত সেই প্রথম নাটক যথেষ্ট প্রশংসা কুড়ালো প্রচারের পরে। তারপর দিতি পরিচালিত-নির্মিত বেশ কয়েকটি নাটক আমাদের চ্যানেলে প্রচার হলো স্বল্পসময়ের ব্যবধানে।

এরপর নানাভাবে শিল্পী দিতি আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। তার একটি হলো, আমার লেখা ‘ছোটকাকু’ ধারাবাহিক যখন নির্মাণ শুরু করলো বন্ধু আফজাল হোসেন, তখন ছোটকাকু চরিত্রের যে বাড়িটি ক্যামেরার সামনে ধরা হলো সেটি ওই দিতির গুলশানের ফ্ল্যাট! দিতির একটি ফ্ল্যাট আছে। যেখানে কিছু কিছু নাটকের শুটিং করতে দেয়া হয়। নির্মাতা আফজালের চোখে ওই ফ্ল্যাটটা নির্বাচিত হলো ছোটকাকুর ঘর হিসেবে। ফলে ওই বাড়িকে কেন্দ্র করে আমার গল্পের চিন্তা এগোতে থাকলো তর তর করে। স্বভাবতই দিতির অবস্থান আমার লেখায় চলে এলো।

দিতি একসময় ইন্দিরা রোডে ধানসিঁড়ি নামের একটি অ্যাপার্টমেন্ট জোনে থাকতেন। ওটাই ছিল ওর নিজ ঠিকানা প্রাথমিকভাবে। সেখানে আমার পরিচিত একজন থাকতেন। আমার কন্যাদ্বয় মেঘনা-মোহনার স্কুলের বন্ধু ছিল সেই পরিচিত ব্যক্তিটির সন্তান। সে উপলক্ষে নানা সময় সেখানে যাওয়া হতো আমার। তখন ওইখানে একজন চিত্রনায়িকা থাকে, সেটিও জানা হয়ে গেল।

এরপর নানা ঘটনায় দিতি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। সেই সূত্র ধরে আমরা কাতারে এক অনুষ্ঠানে দিতিকে আমাদের সঙ্গী হতে বললাম। দিতি সরাসরি আপত্তি করলেন। বললেন, ‘আমি কেন যাবো কাতারে? ওই অনুষ্ঠানটি তো আপনারা করছেন গানের শিল্পীদের নিয়ে। আমি কোন যুক্তিতে ওখানে কাবাব মে হাড্ডি হবো?’  জানালাম ‘আপনি শুধু অভিনয় শিল্পী কি? গায়িকাও। গান গাইতেই চলেন।’

দিতির  সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘আমি তো সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। শিডিউলের অবস্থাও খুব ভালো না। আমার গলার অবস্থাও খুব চমৎকার না। নেই বহুদিনের প্র্যাকটিস। এ অবস্থায় আমি কি লাফিয়ে গিয়ে গান গাইতে পারবো?’ বললাম, ‘অনুষ্ঠান তো আগামীকাল হচ্ছে না। মন চাইলে চেষ্টা করেন। হাতে সময় প্রচুর।’ তারপরের ঘটনা সিনেমার মতো।

রীতিমতো রেওয়াজ করলেন দিতি। তৈরি করলেন নিজেকে। তারপর কাতারের প্লেনে ওঠার জন্য নিজেকে যোগ্য করে সম্মতি জানালেন। যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন দিতি আপডেট জানাচ্ছিলেন। সফল একটি অনুষ্ঠান করে, সবাইকে প্রায় চমকে দিয়ে দিতি ফিরে এলেন কাতার থেকে বাংলাদেশে। তারপর মাঝে অনেক সময় গড়ালো।

দিতির ছেলেমেয়েরা তখন থাকে কানাডায়। পড়ালেখার পার্ট চুকিয়ে ওরা দেশে ফিরবে বলে জানালেন দিতি। কন্যার একটা খুব প্রিয় কুকুর ছিল কানাডায়। কুকুর যারা লালন করেন তারাই শুধু জানেন কুকুরের মায়া ভয়ংকর। ওদের মায়া কেড়ে নিতে জুড়ি নেই। দিতির মেয়ে বায়না ধরলো, দেশে ফেরার সময় কুকুরটি নিয়ে ফিরতে চায়। দিতি আমাকে ধরলো। নানা বিধিব্যবস্থা পার করে ওর মেয়ের কুকুরকে নিয়ে যেন প্লেনে ফিরতে পারে!

সেই কুকুর দেশে ফিরলো। দেশে ফেরার পরে হয়তো এদেশের হাওয়া বাতাস ওর জন্য সহনীয় ছিল না। সেই কুকুরের মৃত্যুতে কন্যার সঙ্গে দিতির বেদনাবোধ আমি পরিষ্কার প্রত্যক্ষ করেছি। গোছগাছ চিন্তার এই সিঙ্গেল মাদার যখন জীবনের একটা প্রান্তে এসে সন্তানদের নিয়ে সুখের ভাবনায় বিভোর হবেন, তখনই ভাগ্যের বিড়ম্বনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন! অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হলো দিতিকে। সেখানেও সঙ্গী হলো ছেলেমেয়েরা।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব গুলজার সাহেব ঘনিষ্ঠতার কারণে তার মাধ্যমে সময়ে সময়ে দিতির শরীরের সর্বশেষ সংবাদ পাচ্ছিলাম। দেশে ফেরার পর নানাভাবে খবর পেয়ে যাচ্ছি। দিতি ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সুচিকিৎসায় আছেন। হাসপাতালের কর্ণধার ব্যক্তিত্বরা আমার বন্ধুস্থানীয়। ফলে তাদের কাছ থেকে প্রায়ই আন্তরিকতার সঙ্গে খবর পাচ্ছি দিতির। সকালবেলায় অরুণ আমাকে  বলে, দিতির অবস্থা খুব ভালো বলা যাবে না বর্তমানে।

একই কথা শুনে আসছি গত দশ সপ্তাহ ধরে। আমার এক প্রিয় বন্ধু ড. এহসান মাহমুদ পিন্টুকে পাঠাই দিতির খবর নিয়ে আসতে। সে এসে গম্ভীর মুখে জানায়  দিতির শরীরের অবস্থা ভালো না। তার  জন্য ওষুধের সঙ্গে দোয়া প্রয়োজন।

বন্ধু পিন্টুর কথার সূত্র ধরে আমিও আন্দাজ করছি, খুব ভালো অবস্থায় নেই আমাদের দিতি। তাই প্রার্থনা করি একজন ভালো অভিনেত্রী, একজন ভালো মানুষের আরোগ্য। তাঁর চমৎকার দৃশ্যমান জীবন আমাদের সবার কাছে খুবই প্রয়োজন! -মানব জমিন
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে