বৃহস্পতিবার, ০৩ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৫৫:২৩

‘আমি প্রথম যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম তখন কেঁদেছিলাম’

‘আমি প্রথম যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম তখন কেঁদেছিলাম’

বিনোদন ডেস্ক : উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একজন কিংবদন্তি অভিনেতা, আবৃত্তিকার। আবৃত্তি, মঞ্চ ও টিভি  নাটক এবং চলচ্চিত্রাঙ্গনে সরব পদচারণা তার। কখনো অভিনয় করতে, কখনো নাট্যেৎসব উদ্বোধন করতে আবার কখনোবা পুরস্কার নিতে ওপার বাংলার এই তারকা ঢাকায় আসেন। এবার এসেছিলেন পুরস্কার গ্রহণ করতে। ২রা মার্চ সন্ধ্যায় রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আবৃত্তির জন্য ‘সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করে কাজী সব্যসাচী পরিবার। পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি ও নানান প্রসঙ্গে কথা বলেন তিনি। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মারুফ কিবরিয়া

প্রশ্ন : ‘সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার’পেলেন। কেমন লাগছে?
উত্তর : এটা সত্যিই আনন্দের বিষয়। কাজী সব্যসাচী শিল্পটাকে লালন করেছে, ধারণ করেছে। আজ তার পরিবার তাকেই স্মরণ করে এ ধরনের একটি আয়োজন করলো তা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। সব্যসাচী আবৃত্তি মাধ্যমটাকে একাই শিল্প হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ওর কণ্ঠস্বরে জাদু ছিল, ইন্দ্রজাল ছিল।

প্রশ্ন : এর আগেও একটি নাট্যোৎসবে ঢাকায় এসেছেন। এবারও এলেন। কেমন লাগছে?
উত্তর :  বাংলাদেশে এলে আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। এদেশের মানুষ আমাকে এত ভালোবাসে, তা না এলে বিশ্বাস করতাম না। আমি প্রথম যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম তখন কেঁদেছিলাম। একই ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা অথচ আমাদের দেশ আলাদা। এটা ভাবলেই মনটা খারাপ লাগে।

প্রশ্ন : আপনার অভিনয়ে আসার গল্পটা শুনতে চাই...
উত্তর : বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখনও অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ বা সম্ভাবনা ছিল না। সে কারণেই হয়ত বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তি করতে দেখেছি। এ-সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ জন্মে। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় ও আবৃত্তি করতে হয়। এভাবে চিন্তার ক্রমাগত উৎকর্ষে পরবর্তী সময়ে কলকাতায় শিশির কুমার ভাদুড়ীর অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বাড়ে।

প্রশ্ন : অভিনয় করে এত মানুষের মন জয় করবেন, তা কি কখনও ভেবেছিলেন ?
উত্তর : না, সেটা ভাবিনি। অভিনয় করব কিংবা দর্শক-শ্রোতা-ভক্তদের ভালোবাসা কাড়ব, সে নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা ছিল। কারণ ছেলেবেলায় আমি দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলাম না। ভাবতাম সংকোচ ও রুগ্ন দেহ নিয়ে কীভাবে আমি এই পথ পাড়ি দেব ?
চলচ্চিত্রে দীর্ঘসময় আপনি কাজ করেছেন। কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে আপনার চলচ্চিত্রে অভিষেক।

প্রশ্ন : কীভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন?
উত্তর : আমি যখন এমএ পড়ি তখন ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন জগদ্বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এরপর তিনি এর দ্বিতীয় পর্ব ‘অপরাজিত’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবতে শুরু করলেন। এটার জন্য একজন অভিনেতা খুঁজতে লাগলেন। সত্যজিৎ রায় তার সহকারীর বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারেন সৌমিত্র নামের একটি ছেলে অভিনয় করে। অভিনয়ের প্রতি তার বেশ আগ্রহ। তার মাধ্যমেই একদিন সত্যজিৎ বাবুর মুখোমুখি হলাম। সত্যজিৎ বাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন- ‘তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে’। তারপর আমার কাজের তত্ত্বতালাশ করে আমাকে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। আমার অভিনয় দেখে আস্থা পেলেন। এরপর সুধীজনের আগ্রহ ও দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় তিনি আবার পরবর্তী সিনেমার কাজে হাত দেন। সেটির নাম ‘অপুর সংসার’। আমার সঙ্গে কোনোরকম কথা না বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অপুর সংসারে আমার কাজ করতে হবে। এভাবেই শুরু। তারপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছি। তখন আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কাজ করি।
আপনি গান, কবিতা ও নাটক লিখেছেন। সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। কবিতা লিখতে শুরু করেছেন কবে থেকে ?
কিশোর বয়সেই কবিতা লিখতে শুরু করি কথা প্রকাশ করার প্রয়াসে। এর মূল উৎসটা অব্যক্ত। এখনকার সময়ে ছেলেরা যেখানে-সেখানে মেয়েদের নিজের গোপন কথাটি বলে দেয়, হাত ধরে ফেলে। আমাদের সময় সেটা অত সহজ ছিল না। সে অব্যক্ত বাসনা প্রকাশের তাগিদেই কবিতা লেখা শুরু।

প্রশ্ন : আপনি তো শুধু কবিতাই নয়, নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার তাগিদ পেয়েছেন কোথা থেকে ?
উত্তর : প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লিখেছি। নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বোধ আর উপলব্ধির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সময়ের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে নাটকের সংলাপ লিখেছি। এ পর্যন্ত ত্রিশটির মতো নাটক লিখেছি। তবে সেটা কতটা নাটক হয়েছে কি হয় নি, তা আমি বলতে পারব না।
আপনি এই বয়সে এসেও মঞ্চে নাটক করছেন। আপনার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় নাটকের ভবিষ্যৎ কী বলে মনে হয় ?
আমি মনে করি, অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনও বিফলে যায় না। অতীতে যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়ত। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে নাটকের ভবিষ্যৎ।

প্রশ্ন : নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্বকে আপনি কীভাবে দেখেন ?
উত্তর : কলকাতার পেশাদারী নাট্যচর্চার ইতিহাস প্রায় শত বছরের। সেটার চর্চা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে এসেছে অনেক বছর। কখনও সে গতিসীমা কমেছে আবার কখনও তা হয়েছে প্রাণবন্ত। এভাবে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে চলছে এ কর্মযজ্ঞ। তবে আমরা অনেক সময় প্রফেশনালিজমের সঙ্গে কমার্শিয়ালিজম মিলিয়ে ফেলি। সব কথার বড়ো কথা হলো আমাদের দায়। সর্বোত্তম ক্ষমতা দিয়ে সৃজনশীল মানুষকে তুষ্ট করতে হলে, সে দায়কেই মূল উপজীব্য মনে করে নিতে হবে।

প্রশ্ন : অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন কতটুকু বলে মনে করেন ?
উত্তর : অভিনয়ে ভীষণ দরকার আবৃত্তিচর্চা। যারা এটা বোঝেন না তারা এখনও চোখ বুঁজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি এখনও প্রতিদিন সুযোগ পেলেই সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। সর্বোপরি একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দকে আঁকড়ে থাকতে হয়, তা হলো ভালোবাসা। কারণ ভালোবাসা ছাড়া কিছু হয় না। -মানব জমিন
৩ মার্চ, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে