রবিবার, ২০ মার্চ, ২০১৬, ১১:৩০:২২

দিতির শেষ বিদায়ে হাসপাতালে সহকর্মীদের কান্নার রোল

দিতির শেষ বিদায়ে হাসপাতালে সহকর্মীদের কান্নার রোল

জিহরুল ইসলাম : ঢাকাই চলচ্চিত্রঅঙ্গনের বরেণ্য অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতি। তিনি প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ঢাকাই সিনেমার অন্যতম সেরা নায়িকা দিতি। আজ রোববার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি…..রাজিউন)।

বর্তমান প্রজন্মের অনেক অভিনয়শিল্পীরা দিতিকে আইডল হিসেবে মানেন। গুণী এই অভিনেত্রীর সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে অভিনয় করে অনেক কিছুই শিখেছেন তারা। শুধু এই প্রজন্মের নয়, দিতির সমসাময়িক তারকাদের হৃদয়ে জমে আছে অনেক স্মৃতি। না বলা অনেক কথা।

প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্টের ছায়াও তাদের মধ্যে ভর করেছে। শোকের এই ছায়া পড়েছে পুরো চলচ্চিত্রাঙ্গনেও। সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী দিতির সহশিল্পীরা দিতির শেষ বিদায়ে একবারের মতো দেখার জন্য ছুটে আসেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে তারকাদের শোকাতুর আহাজারিতে ভারি হয়ে যায় হাহাকারের বাতাস। কয়েকজন সহকর্মীদের শোক গাঁথা :

 
শবনম : দিতির সঙ্গে আমি দুটো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। একটি পাকিস্তান বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার 'লেডি কমান্ডো এবং অন্যটি সুভাষ দত্তের 'সহধর্মিনী'। আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ ছিলো দিতি। সবসময়ই হাসি তার মুখে লেগেই থাকতো। এমন মানুষ ইন্ডাষ্ট্রিতে বিরল। আমি তার আত্নার শান্তি কামনা করছি।

চিত্রনায়ক উজ্জল : দিতির প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র 'আমিই ওস্তাদ' চলচ্চিত্রে আমি তার বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আর তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'রাজা বাবু'তে আমার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো। সত্যি বলতে কি খুব দুঃখ হয় দিতির এভাবে চলে যাওয়াটা নিয়ে। এটা সত্যি যে শিল্পীদের অনেক যুদ্ধ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। দিতির সেই সাহস ছিলো যুদ্ধ জয়ী হবার। জীবন যুদ্ধে দিতি জয়ী হয়েছিলো। কিন্তু আমি যেন আমার ছোটবোনটাকে হারালাম!

 

ওমর সানি : হ্যাঁ আমি শুনেতে পেয়েছি। এখন ওনাকে (দিতি) ইউনাইটেড হাসপাতালে যাচ্ছি (অনেকটা আবেগ জড়ানো কণ্ঠে)। ওনাকে (দিতি) নিয়ে এত স্মৃতি জমা আছে যে, তার থেকে কটার কথা বলবো আপনাকে (এ কথা বলেই কেঁদে ফেলেন এই ওমর সানি)। আমি এখন কথা বলতে পারছিনা পরে কথা বলব?

ফেরদৌস : আমজাদ হোসেন পরিচালিত 'কাল সকালে' চলচ্চিত্রে দিতি আপুর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। এরপর আর কাজ করার সুযোগ হয়নি। দিতি আপু অসাধারন একজন মানুষ ছিলেন। তার মতো এতো বিনয়ী, এতো হাসিখুশি মানুষ চলচ্চিত্রে দেখিইনি আমি। আমার দুভার্গ্য যে হয়তো তাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারবোনা। কারণ আমি একটি জরুরী কাজে দিনাজপুর এসেছি।

ববিতা : দিতি আর আমি বলা যায় আমরা একই পরিবারের সদস্য। সোহেল খুন হবার পর দিতি খুব কষ্ট করে দুই ছেলে মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছে। সত্যি বলতে কি দিতি আমার জুনিয়য়র হলেও তারসঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুর মতো। আউটডোরে যখন শুটিং-এ যেতাম তখন আমরা এক গাড়িতে করেই শুটিং-এ যেতাম। গল্প করতে করতে পথ হয়তো শেষ হয়ে যেতো কিন্তু' গল্প শেষ হতোনা। আমার নিজের প্রযোজনা সংসার' থেকে 'চ্লিদাস ও রজকিনী' চলচ্চিত্রে তাকে নিয়ে কাজ করেছিলাম। একজন ডেডিকেটেড শিল্পী ছিলো দিতি। সর্বশেষ তাকে যখন দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুমো খাচ্ছিলো বার বার। সেই শেষ স্মৃতি কখনোই ভুলবোনা। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্তবাসী করেন।

ইমন : আমি কিছুক্ষণ আগে এই দুঃসংবাদটি পেয়েছি। এখন আমি শুটিংয়ে আছি। খবরটি শোনার পর শুটিংও ঠিকমতো করতে পারছি না। খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট লাগছে। আমি দিতি আপুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এই চলচ্চিত্র চাষী নজরু ইসলাম স্যারের সর্বশেষ চলচ্চিত্র। দিতি আপু অভিনীতও শেষ চলচ্চিত্র এটি। নজরুল স্যার অসুস্থ হওয়ার পর আমি আর দিতি আপু শুটিং সেটে আলোচনা করছিলাম, সিনিয়র সবাই কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারপর-ই অসুস্থ হন দিতি আপু। অবশেষে উনিও চলে গেলেন। গুরুজন, প্রিয়জনকে একএক করে হারাচ্ছি।

ইলিয়াস কাঞ্চন : আমাদের প্রত্যেককেই দিতির মতো একদিন চলে যেতে হবে। তার এভাবে চলে যাওয়া থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে যে আমাদেও কে যেকোন সময় আল্লাহর কাছে চলে যেতে হবে। দিতি আমার একজন ভালো সহকর্মী ছিলেন। তার চলে যাওয়ায় শুধু একটি কথাই বলবো আর তা হলো আল্লাহ যেন তার গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে বেহেস্ত নসীব করেন।

রিয়াজ : দিতি আপুর সঙ্গে চলচ্চিত্রের আসার প্রথমদিন থেকেই আমার বেশ ভালো পরিচয় এবং পারিবারিক সম্পর্ক। সৈয়দ হারুনের একটি চলচ্চিত্রে তারসঙ্গে প্রথম অভিনয় করি। এরপর 'আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা', 'সুইটহার্ট'সহ আরো বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করি। একজন মানুষ কতোটা উদার আর মহান হতে পারেন দিতি আপা ছিলেন তার যথাযথ উদাহরণ। এমন মানুষ সত্যিই আমাদের চলচ্চিত্র জগতে খুবই কম আছেন। তার এভাবে চলে যাওয়াটা সত্যিই মেনে নেবার মতো নয়। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসীব করেন।

পূর্ণিমা : চলচ্চিত্রে আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন দিতি আপা। তারএভাবে চলে যাওয়াতে সত্যিই ভীষণ ক্ষতি হয়েগেলো আমাদের। দিতি আপু শুধু একজন অভিনেত্রীই ছিলেন না আমাদের একজন অভিভাবকও ছিলেন।  একজন মানুষ কতোটা বড় মনের হতে পারে তিনি যেন তারই উদহারণ।

বাঁধন : আমি পুবাইল থেকে শুটিং বাতিল করে চলে আসছি। দিতি আপার কাছে যাচ্ছি। আমি কিচ্ছু বলতে পারব না, কিচ্ছু না।

অঞ্জনা : এফডিসির প্রিয়মুখ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দিতির সাথে পরিচয় হয়েছিল। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠতা। আমাদের বাসা ছিল পাশাপাশি, এমনকি দুজনের রুমের জানালাও ছিল পাশাপাশি। সেই জানালা দিয়েই দুজন কথা বলতাম। আমার মাও দিতিকে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের সাথেও দিতির কথা হতো। দিতিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু আমি ওর লাশ দেখতে যাব না। জসিম ভাইয়ের লাশ দেখার পর থেকে আমি আর কারো লাশ দেখতে পারি না।

পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন : দিতি অভিনীত সবশেষ সিনেমা 'সুইটহাটর্'-এর পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন বললেন, 'ব্যাপারটা খুবই দু:খজনক। তিনি আমাদের এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন তা আমরা কখনোই ভাবিনি। তার মৃত্যুসংবাদে আমি খুবই মর্মাহত।' ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিতে দিতির কাজ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, 'শুটিং এর সময় আমাদের সব কিছুই তিনি খেয়াল রাখতেন। তিনি আমার কাছে আমার আপন বড় বোনের মতো ছিলেন।'

উল্লেখ্য, মস্তিষ্কে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ায় গত ২৫ জুলাই থেকে ভারতের চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রমাটোলজি (এমআইওটি) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন দিতি। মাঝে কিছুটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন।

শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গত বছরের নভেম্বরে আবারও একই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৮ জানুয়ারি এ অভিনেত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে ফেরার পরপরই তাঁকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। দিতি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের নিউরো সেন্টার বিভাগের পরিচালক সৈয়দ সায়ীদ আহমেদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
২০ মার্চ, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে