সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬, ০৫:৫৬:০৫

ভারত মা বনাম ভারত মাও!

ভারত মা বনাম ভারত মাও!

শ্রীজাত : মনে রাখতে হবে, বিপ্লব যেমন কোনও নৈশভোজ নয়, তেমনই সিনেমাও কোনও ‘লেগো’র কিট নয়। যার অংশগুলো জুড়ে দিলে একটা না একটা আকৃতি খাড়া হয়ে যাবে! ‘বুদ্ধ ইন আ ট্র্যাফিক জ্যাম’ তেমনটাই মনে করেন সাংবাদিক শ্রীজাত।

‘বিপ্লব কোনও নৈশভোজ নয়’— মাও’এর এই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ হচ্ছে যে ছবি, সেই ‘বুদ্ধ ইন আ ট্র্যাফিক জ্যাম’ দেখার পর, কথাটা আরও একবার প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে বইকী। যদিও এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে না, যে বিপ্লবকে দেখার দৃষ্টিসংখ্যা নেহাত কম নয় পৃথিবীতে। অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লব ব্রিটিশ শাসকের কাছে সন্ত্রাস ছিল, আমাদের কাছে তা-ই ছিল অস্তিত্বের লড়াই।

এমন অনেক ধাঁধা এখনও আমাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই হুট করে ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও সংগঠনকে বিপ্লবী কিংবা সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়ার আগে দু’বার ভাবনা অমূলক নয়।

এমন ভাবনার দুটি পিঠই বারবার উঠে এসেছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর সাম্প্রতিকতম ছবিতে, যেখানে মাওবাদী ভাবধারা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধের একটা ধাঁচ তৈরি করার কথা ভাবা হয়েছে। মোট কথা, ভারত মা বনাম ভারত মাও। ভাবা হয়েছেই বলছি, কারণ ধাঁচখানা পুরোপুরি বানিয়ে ফেলা হয়তো বা দুষ্কর। বলা ভাল, সম্ভাবনাহীন। সমীকরণ এখানে ততখানি সরল নয়।

বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন শিক্ষক, তার স্বপ্ন বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ‘ভারত সরকার’এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যদিও স্বপ্নটি তিনি যথেষ্ট গোপনভাবেই দেখে থাকেন এবং তার ক্লাসরুমের স্ফুলিঙ্গসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের দেখাতেও চান। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, এই বিশ্বাসে অনড় মানুষটি চান পুঁজিবাদের রক্তমাখা সূর্য ওঠাতে, গোটা দেশ জুড়ে।

মুশকিল হচ্ছে, যে ছাত্রটিকে তিনি নানা অছিলায় দলে টানার চেষ্টা করেন, সে এমন এক বিজনেস মডেল চালু করতে চায়, যার ফলে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার আদিবাসী জনসমষ্টির হাতে মুনাফার লভ্যাংশ পৌঁছবে। প্রস্তাব মন্দ নয়। কিন্তু এতে মাওবাদীদের অস্তিত্ব সংকট বাড়বে। রাষ্ট্র তাদের পিষে ফেলতে চায়। তাদের শেষ আশ্রয় এই অরণ্য, শেষ প্রজা এই আদিবাসীরা। তারাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে গেলে মাওবাদী সংগঠনের পক্ষে এভাবে কাজ চালানো মুশকিল। ফলে, খতম করে দাও ছেলেটিকে। অর্থাৎ, দারিদ্র্য নিকেশ হলে ‘বিপ্লব’ খাবে কী?

ছবিটি মোটের উপর খুব মন্দ নয়। দারুণ কিছুও নয় তাই বলে। আমার মতো একজন সাধারণ দর্শকের মনে গোটাকয়েক প্রশ্ন অন্তত জাগাতে পেরেছে, এই বা কম কী? যদিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অতিসরলীকরণের একটা প্রবণতা দেখা গিয়েছে। বোঝা গিয়েছে, পরিচালক এখানে আর ‘অবজার্ভার’ থাকছেন না।

বরং হয়ে উঠতে চাইছেন ‘স্টেটমেন্টেটিভ’ বা বক্তব্যপ্রধান। তাতেও দোষ নেই। ‘দেশপ্রেম’-এর ধ্বজা ওড়ানোর রাজনৈতিক অভিসন্ধি কোথাও খুব প্রকটভাবে আছে বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। যদি-না নিতান্তই বুঝতে ভুল করে থাকি। তবে খুব সাদা আর খুব কালোর মাঝখানের এলাকাগুলি বিবেক সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। সেখানেও বহু মানুষ ও তাদের মতামত থাকে।

কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের বাইরে এসে যে প্রশ্নটা আমাকে ছবিতে অন্তরীণ জিজ্ঞাসাগুলোর চেয়েও বেশি ভাবিয়ে তুলল তা হল এই যে, এই ছবিটিকে ঘিরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অমন একখানা হইচই হওয়ার কারণ ঠিক কী? মুক্তির কয়েকদিন আগে তার প্রাইভেট স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থার অনুমতি দেওয়া এবং পরে সেই অনুমতি প্রত্যাহার এবং তারও পরে খোলা মাঠে তার প্রদর্শন— ছবিটি দেখে তাকে এত কিছুর যোগ্য বলে অবশ্য মনে হল না।

‘কলকাতা ৭১’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ বা ‘গণশত্রু’র মতো স্ট্রং পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ বলে কখনওই মনে হয়নি ছবিটিকে। নিদেনপক্ষে অনুরাগ কাশ্যপের ‘গুলাল’ হলেও বোঝা যেত। রাজকীয় হাঙ্গামা বাধার কোনও ব্যাপক উস্কানি ছবিটার মধ্যে অন্তত ছিল না। ছিল কিছু সংলাপ, কিছু পুরানো ডিসকোর্সের নতুন মোড়ক, কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন, যা ভারতের নাগরিক হিসেবে আমরা আগেও পেয়েছি নানা শিল্পে। কিন্তু যাদবপুরে লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষই বড় হয়ে উঠল সেদিন। এবং হঠাৎই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে ভরে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ!

এখানে এমন একখানা প্রশ্ন হয়তো অতিসরলীকরণের দিকেই যাবে যে, তাহলে কি বিজেপি ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই আস্তানা গড়ে তোলার অভিসন্ধিতে আছে? নইলে আরএসএস’এ নাম লেখানো এবিভিপি কোন উপায়ে যাদবপুরের মাটিতে একটু হলেও সমর্থন পেয়ে যায়? এই প্রশ্নটা বোধহয় উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী এবং বিজেপি ও এবিভিপি সমর্থকেরা (এই দুইয়ের মধ্যে রেখা টানাও এই ঘটনার পর বিশেষ সরল নয়, কারণ সর্ষের মধ্যেই যে ভূত রয়েছে, তা স্পষ্ট)— ছবিটিকে দু’পক্ষই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন। এ কথা হলফ করে বলা যায়। কিংবা ছবির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে প্রতিচ্ছবি।

তবে হ্যাঁ, সত্যিকারের উদ্বেল করে দেওয়ার মতো ‘রাজনৈতিক’ ছবির অভাব দেশে দীর্ঘদিন ধরে থাকলে মধ্যমানের ছবি নিয়েই বিপ্লব ফলাতে হয়! বিষয়টা সেইদিকে গিয়েছে। কিন্তু তার চাইতেও যা ক্ষতিকারক, তা হল এই ধাঁচা। ট্রেন্ড। যা ছাত্র রাজনীতির আড়ে তৈরি হচ্ছে হয়তো বা গোটা দেশ জুড়ে।

এ ছবির পরিচালক বিবেক সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে নাকি সম্রাট অশোক, গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে একই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম উল্লেখ করেছেন (তাতে দোষ নেই, জনৈক বাঙালি বিদ্বজ্জনের হিসেব অনুযায়ী এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তুলনীয় এবং তার পরিপূর্ণতা দান্তের বিয়াত্রিচের চেয়ে কম কিছু নয়! সুতরাং মেধা বিক্রির এ-ও এক ট্রেন্ড)। যদিও ছবিটি দেখে তাকে এতখানি স্থূল বলে মনে হয়নি আমার। অবশ্য কোথায় কী কারণ লুকিয়ে থাকে, কে বলতে পারে।

চিন্তা একটাই। ‘বুদ্ধ ইন আ ট্র্যাফিক জ্যাম’কে ঘিরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে চিহ্নিত করলে আমরা নিশ্চিত ভুল করব। এটা একটা প্রবণতা। একটা নকশার অন্তর্গত কার্যকলাপ। যাকে আমাদের চিনে নিতে হবে, বিরোধিতা করতে হবে, শেষমেশ রুখে দিতে হবে। যা এবার যাদবপুর ভালভাবেই করেছে। আর মনে রাখতে হবে, বিপ্লব যেমন কোনও নৈশভোজ নয়, তেমনই সিনেমাও কোনও ‘লেগো’র কিট নয়। যার অংশগুলো জুড়ে দিলে একটা না একটা আকৃতি খাড়া হয়ে যাবে! সিনেমা এক ধরনের রাজনীতি, এক ধরনের দর্শন, এক ধরনের সংক্রমণ। বিবেক আর অগ্নি পাশাপাশি থাকা ভাল, যতক্ষণ না বোধ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!   

১৬ মে ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে