বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন, ২০১৬, ০২:৪১:৪৭

ধন্যবাদ জাকারবার্গ

ধন্যবাদ জাকারবার্গ

জাহীদ রেজা নূর: ‘রাত সাড়ে ১২টায় মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ: ভাই, লিংকটা দেইখেন।’ মেসেজটা চারুকলা পাস ব্যান্ড সংগীত শিল্পী মনোয়ারুল হকের পাঠানো। আইয়ুব বাচ্চুর লিংক। ফেসবুকে এই রকস্টার তাঁর ভক্তদের গান লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রথমে তিনি লিখে দিয়েছেন দুই লাইন।‘একজন মানুষ তপ্ত রোদে পুড়ে, ঘাম ঝরে তার সারা শরীরটা জুড়ে।’ এরপর তাঁর ভক্তরা যোগ করেছেন নতুন লাইনগুলো। ফেসবুকে সেদিন যেন দেখা গিয়েছিল সৃষ্টিসুখের উল্লাস। একের পর এক পঙ্ক্তি আসতে থাকে আর রোমাঞ্চিত হন আইয়ুব বাচ্চু। গড়ে ওঠে পুরো একটি গান। বিশাল তার দৈর্ঘ্য। লিংকটা দেখে মনোয়ারুলকে লিখি, ‘বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা যায়?’‘চেষ্টা করে দেখি।’ কিছুক্ষণ পর মনোয়ারুলের মেসেজ, ‘ভাই, আপনি এলে বাচ্চু ভাই কথা বলবেন।’
বললাম, ‘তথাস্তু।’

এবিস কিচেনে
রোববার পড়ন্ত বিকেলে মনোয়ারুল হক, আলোকচিত্রী সাজিদ আর আমি পৌঁছে যাই এবিস কিচেনে। মাথায় ক্যাপ, কালো পোশাকে আইয়ুব বাচ্চু এলেন। তাঁর সঙ্গে সখ্যের মূল মিলনক্ষেত্র হলো আজম খান। আমরা একটা পুরো প্রজন্ম আজম খানের বলিষ্ঠ উচ্চারণের ছায়ায় গড়ে উঠেছিলাম। তাই আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে কথোপকথন শুরু হলে ঘুরেফিরে পপ সম্রাট আজম খানের কথা চলে আসে। সে এক অন্য ইতিহাস। এখানে বরং আমরা দৃষ্টি রাখি ২৫ জন মিলে লেখা গানটির বিষয়ে। বললাম, ‘গানটির জন্ম-ইতিহাসটা বলবেন বাচ্চু ভাই?’ ‘নিশ্চয়ই বলব, ভাই। এ জন্যই তো আপনার সঙ্গে কথা বলা! শোনেন, হঠাৎ মাথায় একটা ভাবনা এল। একজনের লেখা আর সুরে ২৫ জন, ৫০ জন, ১০০ জন বা আরও বেশি মানুষ গান করেছে।

কিন্তু বিষয়টা যদি রিভার্স করি, পাল্টে দিই, তাহলে কেমন হয়? যাঁরা আমাদের গান শোনেন, তাঁরা কি দু কলম লিখতে পারেন না? তাঁদের কেউ কি প্রেমিকাকে চিঠি লেখেন না? তখন আমি ফেসবুকে এই আহ্বান জানাই। মনোয়ারুল হক আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে। আমি প্রথম দুই লাইন লিখে ছেড়ে দিলাম ফেসবুকে। তারপর একের পর এক লাইন আসতে থাকল। দারুণ এক একটা লাইন! প্রথমে তা একটু এবড়োখেবড়ো ছিল, অর্থাৎ যেখানে যে লাইনটা বসলে ভালো লাগবে, সেখানে তা ছিল না। মনোয়ারুল মানে মনি বলল, “ভাই আপনি চিন্তা করবেন না। আমি রেডি করে দেব।” সেগুলো ঠিকঠাক করে একটা রূপ দিল।’ শত খানেক লাইন পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তার কিছু ছিল যা মূল বিষয়ের সঙ্গে যায় না। বাচ্চু বললেন, ‘দেখেন, যদি আমি একটি গানের বিষয় ঠিক করি ফোন, ফোনটা আমার। তাহলে আপনি লিখতে পারেন, এই ফোনের নম্বরটা আমার, রংটা আমার ইত্যাদি।

কিন্তু আপনি যদি বলেন ফোনটা আমার, গাড়িটা আমার, বাড়িটা আমার তাহলে তো টপিকের সঙ্গে তা যাবে না। সে রকম যা এসেছিল, তা বাদ দিতে হয়েছে। রেডি করে মনি বলল, ‘ভাইয়া, এটা তো বড় হয়ে গেছে।’ বললাম, এই গানটা আমি করব। ডিক্লারেশন দিয়ে দাও। সন্ধ্যা সাতটায় আইয়ুব বাচ্চুর পক্ষ থেকে ভক্তদের জানিয়ে দেওয়া হয়, ২৫ জন মিলে লেখা গানটি শিগগিরই গাওয়া হবে।

জয় ফেসবুকের জয়
মজা করেই বললেন রকস্টার, ‘জাকারবার্গকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর ফেসবুকের কারণেই আমরা সমবেতভাবে একটা গান লিখতে পারলাম। বাংলাদেশে সম্ভবত এই প্রথম ২৫ জন মানুষ মিলে একটা গান লিখেছে। মনি সাজিয়ে দিয়েছে। আমি এরই মধ্যে সুর করেছি, বারো আনা গেয়েও ফেলেছি। একটু পর আপনারা শুনবেন। বাজিয়ে দেব।’ হাসলেন আইয়ুব বাচ্চু।
‘বুঝলেন, চাইলে ফেসবুকটাকে ভালো কাজে লাগানো যায়। গালাগাল, সমালোচনা করার জায়গায় সৃজনশীল কাজ করলেই ফেসবুকের ভালোটা নিতে পারবেন।’
কাজের শুরু
যাচাই-বাছাই শেষে প্রথম দুই লাইনের পর গানের মুখটা দাঁড়িয়েছে এ রকম:
নেমেছে সে একা পথে কাক ডাকা ভোরে, (নার্গিস আফরোজ চৌধুরী)
তপ্ত দুপুরে কিংবা শীতের প্রহরে ত্রিচক্রের বহরে। (দীপান্বিতা দ্বীপবাসিনী)
তীব্র দহন নোনা শরীরজুড়ে, মন পড়ে রয় তবু একফালি সোনালি রোদ্দুরে। (নাজিয়া জেরিন হোসেন)
শার্টের বোতাম কিছু গেছে খুলে পড়ে, জীবন চলে তার প্যাডেল মেরে মেরে। (মনোয়ারুল হক)
এভাবেই এগিয়ে যায় গান। বিশাল এ গানটি সত্যিই মানুষের মন পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে ছিল সংশয়। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু সুর করতেই কেটে গেল তা। যেন অন্য রকম এক আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে গানটি। অচিরেই এই একক গানটি শুনতে পাবেন শ্রোতারা।

ভাবনার সাঁকো বেয়ে। একটা মিউজিক ভিডিও করার ইচ্ছা। সেখানে একজন মাঝবয়সী রিকশাচালককে দেখা যাবে। বাইরে থেকে ভেসে আসবে গান। প্রশ্ন করি, ‘হঠাৎ এই থিমটা মাথায় এল কেন?’
হাসলেন রকস্টার। বললেন, ‘যখন প্রথম দুই লাইন লিখেছি, তখন মনি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাই, টপিকটা কী?’ বললাম, সিম্পল। খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা তো খেটে খাওয়া মানুষ। কষ্ট করেই তো আয় করি। কিন্তু আমি গান লিখেছি তাদের নিয়ে, যারা আমাদের চেয়ে বেশি কষ্ট করে। ভেবে দেখুন, বৃষ্টির সময় রিকশায় বসে আমরা তো মাথাটা হুডের নিচে বা ছাতার নিচে রাখতে পারছি। কিন্তু রিকশাচালক ওরই মধ্যে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিংবা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খালি মাথায় ঠেলছেন রিকশা। দুই টাকা, পাঁচ টাকার জন্য তাঁদের আমরা থাপ্পড় দিই। ওদের কষ্টের কথা যদি চিন্তা করেন, তাহলে সত্যিই রিকশায় উঠতে পারবেন না! মানুষ হিসেবে তাঁরা তো অনেক বড়।’

একটি আশা:
‘জানেন, আমার যে বিষয়টি ভালো লাগছে তা হলো, এই ফেসবুকে গান লেখার ভাবনাটার পর আমার মনে হচ্ছে, আর কিছু না হোক, বেশ কয়েকজন ভালো গীতিকার আমরা পেয়ে যাব। এরা গান নিয়ে ভাববেন। নতুন নতুন গান লিখবেন! ‘গানটায় সুর দিতে গিয়ে ভাবলাম, কোন পথে গেলে আমি গানটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারব? আমার পরিচয়টা কী? আজম খানের যেমন পরিচয় ছিল “রেললাইনের ওই বস্তিতে”। তাহলে আমারও সে রকমভাবে “আমার পরিচয়ে”র মধ্যেই থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতেই শেষ হলো গানটির সুর করা। এ আমাদের সবার গান।
‘আমি নতুন গীতিকার, সুরকারদের একটা মেসেজ দিতে চাই, যাঁরা গান নিয়ে কাজ করতে চান তাঁদের উদ্দেশে বলি, ওপেন আপ ইয়োর মাইনন্ড। দৃষ্টিভঙ্গি উদার করুন। দৃষ্টি খুলুন। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ান।


আপনার পাশেই রয়ে গেছে প্রতিভা। দূরে যাওয়ার দরকার নেই।’ গান নিয়ে মেতে থাকার এই তিনটি দিন কি আপনাকে একটু অন্য রকম করে তুলেছে? মন খুলে হাসলেন আইয়ুব বাচ্চু, বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন। এই তিনটা দিন আমাকে বদলে দিয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে, মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে, তবে তাঁর কাছে পৃথিবীর আর কিছুই কিছু না।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আজম ভাই শিখিয়ে গেছেন, ভালোবাসো, ভালোবাসতেই থাকো, ভালোবাসাই জীবন।-প্রথম আলো

৯ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে