বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬, ১১:২৭:৪৭

হাউসফুল ‘শিকারি’, হতাশ করেনি

হাউসফুল ‘শিকারি’, হতাশ করেনি

অনিমেষ আইচ : শ্রাবন্তী ও শাকিব খান অভিনীত শিকারি ছবির দৃশ্যগত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি। সব কটি ব্যবসাসফল। তবে এর মধ্যে ‘শিকারি’ এসেছে আলোচনায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ‘হাউসফুল’ যাচ্ছে ছবিটি।

একটা বাংলো বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসেছেন একজন সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক, স্ক্রিপ্টরাইটার ও হিরো। স্ক্রিপ্টরাইটার গল্প শোনাচ্ছেন সবাইকে। ‘একটা দৃশ্যে দেখা যাবে, নায়ক সৎ পুলিশ অফিসার ভিলেন গুন্ডা বাহিনীকে তাড়া করার জন্য পিস্তল বের করে উঁচিয়ে ধরবেন...গল্প বলার ঠিক এই জায়গায় হিরো স্ক্রিপ্টরাইটারকে থামিয়ে দেন, ‘না না...পিস্তল নয়, এখানে একটা তরবারি দিয়ে দিন।’ স্ক্রিপ্টরাইটার বলেন, ‘স্যার, পুলিশের হাতে তরবারি আসবে কোত্থেকে? ‘আরে, তরবারিটা দেখতে ভালো লাগবে। হিরোর হাতে চকচকে তরবারি। দর্শক খুব খাবে।’

কোনো একটা হিন্দি সিনেমায় এমনই একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। ফ্যান্টাসাইজড বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই হয় এবং দর্শক তাদের কল্পনাকে দেখে এবং হাঁ করে গেলে। আমরা হলিউড, বলিউড এবং বাংলাদেশি ফ্যান্টাসাইজড মুভি যখন দেখতে বসি, তখন কাগজ-কলম নিয়ে বাস্তবতার হিসাব করতে বসি না নিশ্চয়ই। আমি নিজেই বাণিজ্যিক ছবির বিরাট একজন ভক্ত এবং দেশি-বিদেশি হিট ছবি দেখতে ভীষণ পছন্দ করি।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। পত্রপত্রিকা ও বন্ধুবান্ধবের কথায় এবারের ঈদের সিনেমাগুলো নাকি দর্শক ভীষণ পছন্দ করছেন এবং তাঁরা দলে দলে ছবি দেখতে যাচ্ছেন। আমিও রবাহূত হয়ে সিনেপ্লেক্সে গেলাম একদিন। ভাবলাম ‘শিকারি’ ছবিটা দেখব। কিন্তু আমাকে হতাশ করে কর্তৃপক্ষ জানাল, ‘আজ এবং আগামী দিনের কোনো টিকিট নাই।’ টিকিট না পেলে মন খারাপের বদলে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। বাহ্! এ রকম দিনের অপেক্ষায়ই তো ছিলাম অনেক কাল! মানুষজন সিনেমা দেখবে, সিনেমা দেখে কাঁদবে, কথা বলবে। এ-ই তো ছিল আমার ছোটবেলার সিনেমা-সংস্কৃতি। কিন্তু তা মাঝখানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

যা হোক, পরবর্তী কোনো এক সময়ে সিনেমাটি দেখতে গেলাম। যেদিন সিনেপ্লেক্সে ছবিটি দেখছিলাম, সেদিন একটাও সিট খালি ছিল না দেখে মনটা আরও ভালো লাগল। আমাদের শাকিব খান। হ্যাঁ, আগেও শাকিব খানের বেশ কয়েকটা সিনেমা দেখেছি। কিন্তু এ যেন এক নতুন শাকিব। চেহারায়, আদতে আর অভিনয়ে তাঁকে দেখতে বেশ ভালো লেগেছে। তার চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, শাকিবের মুখে যখন রবীন্দ্রসংগীত শুনলাম। আগাগোড়া পুরো ছবিটাতেই শাকিবের ভালো অভিনয় করবার প্রয়াস সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার ছবি দেখার জন্য যথেষ্ট ধৈর্যের দরকার। কিন্তু ‘শিকারি’ টিম আমাদের হতাশ করেনি। কখনো মনে হয়নি, সিনেমা হল ছেড়ে বের হয়ে আসি। যদিও এটি একটি রিমেক ছবি।

১৯৯০ সালের মালয়ালাম মুভি ‘His Highness Abdulla’-এর পরবর্তীকালে ২০০৯-এ তামিল ছবি ‘Adavaan’-এর পরবর্তী সংস্করণ ‘শিকারি’। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, বাংলা ও হিন্দি ছবির অধিকাংশই বিবিধ ভিনদেশি ছবির কোলাজ সংস্করণ।

সিনেমাটি আরও একটি শক্তিশালী ভালো ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। তা হলো, দর্শক ধরে রাখার জন্য যৌনতা আর নগ্নতার প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট ভালো ক্যামেরার কাজ, আর্ট ডিরেকশন, গান, মিউজিক আর তার চেয়েও ভালো, ভিলেন মানেই তথাকথিত ভিলেনসুলভ অভিনয় না করার প্রবণতা। অনেক আহামরি সিনেমা না হলেও এ মুহূর্তে বাংলা চলচ্চিত্রে ঠিকঠাক গল্পের সাধারণ সিনেমা হওয়ার যে চাহিদা, তা বেশ খানিকটাই পূর্ণ করেছে ‘শিকারি’।

এবার ছবিটির মন্দ দিক সম্পর্কে খানিকটা বলতে ইচ্ছা করছে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এই ছবির প্রেক্ষাপট, গল্প, অভিনেতা ও অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান, মিউজিক ডিরেক্টর—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশিদের অনুপস্থিতি। একমাত্র সবেধন নীলমণি আমাদের শাকিব। এ ছাড়া আর কোথাও কাউকে সেভাবে খুঁজে পাইনি। অথচ উইকিপিডিয়া দেখে জানতে পারি, ছবির ৭০ ভাগ অর্থ লগ্নি করেছে আমাদের প্রযোজনা সংস্থা জাজ। সে ক্ষেত্রে জাজের প্রতি অনুরোধ, যৌথ প্রযোজনার ছবিতে বাংলাদেশকে আরেকটু বেশি প্রমোট করলে আমরা আরও বেশি আনন্দিত হব বলেই আমার বিশ্বাস। আরেকটি দুর্বলতা, যেটা খুবই পীড়াদায়ক ছিল, তা হলো মাত্রাতিরিক্ত টুইস্টের মাতামাতি। কবি যেখানে নীরব সেখানেই দে ভরিয়া একখানা টুইস্ট; যেসব টুইস্ট অনেকাংশে গল্প আর গতিকে রাশ টেনে ধরেছে মনে হয়।

তবে সবচেয়ে আনন্দের দিক, এই ঘোর অসময়ে দর্শক বিনোদনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকে। ‘সম্রাট’, ‘মেন্টাল’ ও ‘বাদশাহ’র সাফল্যও আমাদের চলচ্চিত্র-দর্শকদের বিনোদিত করেছে। এটা একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আমাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিবর্গকে মনে করিয়ে দিতে চাই: সিনেমা, খেলাধুলায় এবং সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ তৈরি করুন। তাহলে মাদক ও জঙ্গি সমস্যা অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। গোড়ায় জল ঢালুন, নয়তো গোটা গাছটাই মরে যাবে।

ভালো থাকুন। বাংলা সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন। লেখক: চলচ্চিত্রনির্মাতা, - প্রথম আলো
২১ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে