সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪, ০৯:০৫:৩৬

কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হল বৃদ্ধের মরদেহ

কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হল বৃদ্ধের মরদেহ

বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া : মো. আলিম উল্লাহ খান বয়োবৃদ্ধ। থাকেন ঢাকায়। বন্যা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যেই আসেন নিজ গ্রামের বাড়িতে। ফেনী জেলা সদরের মৌটবী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সাতসতী গ্রামের নাছির ভূঁইয়া বাড়িতে আসার পর তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

গত ২২ আগস্ট ভোরে তিনি মারা যান। ওনার সঙ্গে থাকা পানিবন্দি লোকজন অনেক চেষ্টা করেও তার লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। দাফনের ব্যবস্থা করতে দু’দিন অপেক্ষা করেন তারা। এক পর্যায়ে লাশে পচন ধরার ভয় থেকে তাকে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়! আলিম উল্লাহ’র এক ছেলে ও এক মেয়ের কেউ তখন তার সঙ্গে ছিলেন না।

 সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার এক ছেলে মো. মাসুদ খান প্রিন্স লিখেছেন, ‘হে আল্লাহ আমার বাবা যেন একটু মাটি পায়। আল্লাহ তুমি সব কিছুর মালিক, তুমি এই দুর্দিনে আশ্রয় দাও। অন্তত তার কবর যেন জিয়ারত করতে পারি ওই সুযোগ করে দাও।’

আলিম উল্লাহ খানের প্রতিবেশী ও আত্মীয় ওমান প্রবাসী মো. ফারুক জানান, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে তাদের বাড়িরসহ আশেপাশের কয়েকটি পরিবার একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন।

এর মধ্যে আলিম উল্লাহও তাদের মতো পানিবন্দি ছিলেন। তিনি ছিলেন কিছুটা অসুস্থ। এ অবস্থায় তিনি মারা গেলে দাফনের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। অনেক চেষ্টা করে দাফনের ব্যবস্থা করা যায়নি। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই সেখানে থাকা লোকজন একটি ভেলায় করে ওই লোককে ভাসিয়ে দেন।

আরেকটি এলাকায় পানিবন্দি থাকা ফারুকের স্ত্রী শিবলী জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি তাদের আত্মীয়। তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। 
 
ফেনীতে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পানি এতটাই বেড়ে যায় যে, লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারেননি। হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে বেশ কয়েকদিন ধরে। একাধিক দিন না খেয়ে থাকারও খবর পাওয়া যায়। সরকারি উদ্যোগে অনেককে উদ্ধার করা গেলেও তুলনায় সেটি কম। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও বেশি দুর্গত এলাকায় খাবার পৌঁছানোই যায়নি। একাধিক দিন না খেয়ে কিংবা পানি খেয়ে বেঁচে থাকার খবরও আছে। 
 
বন্যা নিয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ফেনীর মো. রাসেলের। খাবারের সন্ধানে এক ভাইয়ের বাড়িতে আসতে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা সাঁতরে পার হয়েছেন। বাকি পাঁচ কিলোমিটারের পথের বেশিরভাগ এসেছেন নৌকায় করে। তাও বেশ অনুরোধ করে নৌকায় উঠতে হয়। কিছু পথ পানি মাড়িয়ে হেঁটে আসেন তিনি।

সাত কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে ওনার সময় লাগে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময়। নিজ গ্রাম মৌটুবি ইউনিয়নের বাঘাইয়া থেকে ফেনী পৌর এলাকার এসএসকে রোডে ভাইয়ের বাড়িতে এসে দেখেন পুরো শরীর সাদা হয়ে গেছে। বড় ভাইয়ের বাসায় এসব বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
 
মো. রাসেল জানান, তার বৃদ্ধ মাসহ সাত সদস্যের পরিবারের সবাই এখনো বাড়ির ছাদে অবস্থান করছেন। শুরুর দিকে দু’দিন না খেয়ে থাকার পর তারা বৃষ্টি পানিতে ক্ষুধা মিটিয়েছেন। এরপর কেউ একদিন এসে মুড়ি দিয়ে যায়। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন।
  
বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারা যায় ‘ফেনী ফুডিস’ নামে একটি ফেসবুক পেজে। পেজটি ঘেঁটে দেখা যায় শত শত আকুতি। পানিতে আটকা পড়া লোকজনকে উদ্ধারের আকুতি বেশি। এছাড়া অনেকে সহায়তার করার ইচ্ছা পোষণ করেও পোস্ট দিচ্ছেন। লেখা হচ্ছে নানা নির্দেশনার কথা।
 
ফেনী-সোনাগাজী রোডের আমির উদ্দিন মুন্সীর হাটের নাজমুন তৃষা নামে পেজটিতে একজন লিখেন, ‘এই গ্রুপে লস্করহাটের কেউ আছেন? আমার বোন, তার দুই ছেলে মেয়ের খোঁজ পাচ্ছিনা চারদিন ধরে।’

ইনুর নাহার রাফি নামে একজন সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছবি পোস্ট করে লিখেন তার মা-বার কোনো খোঁজে পাচ্ছেন না চারদিন ধরে।’ 

মো. রাশেদ নামে একজন সকালে লিখেন, ফুলগাজী উপেজলার পুরাতন মুন্সীর হাটের উত্তর শ্রীপুর সৌদিয়া হোটেলের পাটোয়ারি টাওয়ারে ২৫০+ মানুষ অবস্থান করছে। তিনদিন ধরে তারা বন্যার পানি খাচ্ছে।’

ফাহমিদা রিশাদ লিখেন, আজিম ধুল মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে অনেক মানুষ খাবার সংকটে আছে। আমার চাচা-চাচীও আছে। চারদিন পর তাদের খোঁজ পেলাম। খাবার দিয়ে সহায়তা করুন।’ 

আদনান হাসান নামে একজন লিখেন, ‘পশ্চিম সোনাপুর এ কেউ ত্রান নিয়ে কেউ যেতে পারবেন, ওখানে অনেক মানুষ না খেয়ে আছে।’ 

এদিকে বাবার লাশ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাসুদ খান। তিনি লিখেন, ‘যারা উপস্থিত ছিলেন তারা কিভাবে পারলেন এটা। আরেকটা দিন অপেক্ষা করতেন। পরস্থিতি অনুযায়ি অন্তত তিনদিন রাখা যেতো। কেউ যদি এগিয়ে আসতো তাহলে আমার বাবাকে ফ্রিজিং করে রাখা যেতো।’

এ পোস্টের কমেন্টস এ অনেকে তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে পোস্ট দিয়ে বৃদ্ধের লাশ পেলে যেন কবর দেওয়া হয় সেই কথা লিখে মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে দেন। যদিও গত দু’দিন চেষ্টা করেও এসব ফোন নম্বরে কল যায়নি।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে