শনিবার, ২১ মে, ২০১৬, ১২:৪৯:৩১

চেয়ারম্যানের চেয়ার কতদূর?

চেয়ারম্যানের চেয়ার কতদূর?

জাবেদ রহিম বিজন: এক নির্বাচন থেকে আরেক নির্বাচন। সময় পাঁচ বছর। কিন্তু মিলেনি চেয়ারম্যানের চেয়ার। গেজেটের আশায় আশায় একজন হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়ার দীর্ঘ আইনি লড়াই এখন অনন্য রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস। নির্বাচন কমিশনে স্তূপ হয়েছে তার নথিপত্র। রায় পেয়েছেন অসংখ্যবার। গেজেট অনুমোদন হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু চেয়ারের নাগাল আর পাননি তিনি। ইতিমধ্যে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা হয়েছে। এতে হতাশ হেলাল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরিণতি ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়ন পরিষদের ২০১১ সালের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে কারচুপি করে তার জয় কেড়ে নেয়ার অভিযোগে অবতীর্ণ হন  আইনি লড়াইয়ে।

কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা ফলাফল আর রিটার্নিং অফিসারের দেয়া ফলাফলে কারসাজি স্পষ্ট ধরা পড়ে। কেন্দ্র থেকে ঘোষিত ফলাফলে বিজয়ী ছিলেন তিনি।  হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন- আমার চাওয়া ছিল খুবই সামান্য। পুনঃভোট গণনার দাবি জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু এই পর্যন্ত আসতে হবে তা চিন্তাও করিনি। গেজেট মিলবে না, ৫ বছর সময় লাগবে- এমনটি বুঝতে পারলে কখনো ওপথে যেতাম না। ৫ বছরে তার অর্থ ব্যয়ের পরিমাণও কম নয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ টাকা খরচ করেছেন মামলা মোকদ্দমার পেছনে। সংসার-ব্যবসার দিকে মনোযোগ নেই। নিজের স্বাস্থ্যহানিও ঘটেছে। রায় পাবেন, তার নামে গেজেট হবে- এই আশায় আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আদালত আর নির্বাচন কমিশনে। বললেন- বলতে গেলে আদালত থেকে বেরই হতে পারি না। আমার দিনমান হয়ে উঠেছে এই মামলা। ২৪ ঘণ্টাই এই মামলার দিকে চোখমেলে তাকিয়ে আছি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে কিনা।

একদিনের জন্যে হলেও চেয়ারে বসতে চান হেলাল উদ্দিন। বলেন আমার অভিযোগ যে সত্য তার প্রমাণ দিতে চাই এলাকার মানুষের কাছে। তাদের সামনে সত্য পরিষ্কার হোক। যা করেছি প্রেস্টিজ ইস্যুর কারণে। দীর্ঘ লড়াইয়ে তার উপলব্ধি নির্বাচন নিয়ে যেন মামলা না করে কেউ। আর নিজেও নির্বাচন করবেন না কখনো। বলেন- কেউ যদি ৫ কোটি টাকা দিয়েও বলে নির্বাচন করো তাহলেও নয়। নির্বাচন ভালো মানুষের কাজ নয়। ২০১১ সালের ২২শে জুন অনুষ্ঠিত ঐ নির্বাচনে খাড়েরা দক্ষিণ ভূঁইয়া বাড়ি ফোরকানিয়া মাদরাসা কেন্দ্রের ফলাফল কারসাজি করে পাল্টানো হয়।

কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বায়েক শাহআলম কলেজের প্রভাষক মো. ফরিদ আহাম্মদ স্বাক্ষরিত রেজাল্টশিটে আনারস প্রতীকের প্রার্থী মো. গোলাম জিলানীর ভোট প্রাপ্তি ১৩৬৮ এবং হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়ার (গরুর গাড়ি) ভোট প্রাপ্তি ১২টি দেখানো হয়। কিন্তু রিটানির্ং অফিসার তৎকালীন কসবা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন এই ফলাফলে পরিবর্তন করেন। মো. গোলাম জিলানীকে ১৩৬৮ এর স্থলে ১৪১১ ভোট করে দেন তিনি। মো. হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়ার ভোট ১২টি ঠিক রাখা হয়। মো. গোলাম জিলানীকে অতিরিক্ত ৪৩ ভোট দেয়া হয়। একইভাবে খাড়েরা মোহাম্মদীয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ফলাফলও কারসাজি করা হয়। কেন্দ্র থেকে ছিনতাই হওয়া ২শ ব্যালটের ভোট গোলাম জিলানীর পক্ষে যোগ করে দেয়া হয়। কেন্দ্র দুটির ফলাফল পাল্টানোর বিষয়ে ২০১১ সালের ৭ই জুলাই নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেন হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া। তাতে তিনি কেন্দ্র দুটির ভোট পুনঃগণনার দাবি জানান।

তার দরখাস্ত আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্যে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা-২ কে নির্দেশ দেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন পর্যালোচনা করে ওই বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর পুনঃনির্বাচনের সিদ্ধান্ত দেয়। এরপরই পুনঃনির্বাচনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করেন মো. গোলাম জিলানী। এই রিটের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত আদেশ দেন ৩০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের। পাশাপাশি নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ২০১২ সালের ৮ই আগস্ট গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় মো. গোলম জিলানীর নাম প্রকাশিত হয়। এরপরই হেলাল উদ্দিন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। মামলায় তিনি খাড়েরা মোহাম্মদীয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোট পুনঃগণনা এবং খাড়েরা দক্ষিণ ভূঁইয়া বাড়ি ফোরকানিয়া মাদরাসা কেন্দ্রের ভোট গণনায় ফলাফল বিবরণী সংশোধনের ডিক্রি আদেশ প্রার্থনা করেন।

২ বছর পর ২০১৪ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রিতে মো. হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল ভোট জালিয়াতির অভিযোগে কেন্দ্র দুটির প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তৎকালীন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ নাজমুল হুদা ও মো. ফরিদ আহমেদের (প্রভাষক বায়েক শাহ আলম ডিগ্রি কলেজ) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে কমিশনকে নির্দেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের বিরুদ্ধে মো. গোলাম জিলানী আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। তার এই আপিল ২০১৪ সালের ১লা এপ্রিল খারিজ হয়ে যায়। গোলাম জিলানীর করা একাধিক রিট আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু কোনো স্থগিতাদেশ না থাকার পরও রহস্যজনক কারণে ওই সময়ে মো. হেলাল উদ্দিনের নামে গেজেট প্রকাশ থেকে বিরত থাকে  নির্বাচন কমিশন।

হেলাল উদ্দিন বলেন- ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। বারবার সিভিল রিভিউশন বা রিট করেছেন। একপর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্যে আবার ফিরিয়ে দেয়া হয় নির্বাচনী আপীল ট্রাইব্যুনালে। তিনি জানান- নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল দু-দফা তাকে বিজয়ী করে রায় দেন। সর্বশেষ এবছরের ১৩ই মার্চ মো. হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া ৪৮৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বলে রায় দেয়া হয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী  গোলাম জিলানী পেয়েছেন ৪৮১০টি ভোট। ৪৫ ভোট বেশি পেয়ে হেলাল জয়ী হন। এই রায়ের বিরুদ্ধে মো. গোলাম জিলানী আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। গত ৪ঠা মে এই আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ২৪শে মে রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য্য রয়েছে। এদিকে ২৮শে মে খাড়েরা ইউনিয়নের নতুন ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। উচ্চ আদালতও হেলালের পক্ষে একাধিকবার রায় দিয়েছে। সে মতে মোট ৬ বার তার নামে গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে কমিশন ৪ বার গেজেট অনুমোদন করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই গেজেট আর হয়নি। আইনি ভাবে নতুন করে কোনো বাধা সৃষ্টি হওয়ার আগে গেজেট প্রকাশের অনেক সময়-সুযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন তা করেনি।

হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন-বিচারের দীর্ঘ সুত্রতা আর নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতার কারণে আমি চেয়ারে বসতে পারলাম না। ৪৮ বার আবেদন করে আদালত থেকে সময় নিয়েছেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। এভাবে রিটের ওপর রিট, আপিল করে সময় নষ্ট করা হয়েছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আল মামুন বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হয়ে আছে। আদালতে একের পর এক রিট আবেদনে বিষয়টি এতদূর এসেছে। আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে তো আমাদের কিছু করারও নেই। জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি খুবই জটিল হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মতে আমরা ওই ইউপিতে নির্বাচনের আয়োজন করেছি।-এমজমিন

২১ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে