নিউজ ডেস্ক: চলছে ভরা মৌসুম, তবু নদীতে ইলিশের দেখা নেই। এ কারণে চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল ও পিরোজপুরের পাড়ের হাটের ইলিশ মাছের আড়তগুলোয় ব্যবসায়ীরা এখন অলস সময় পার করছেন। স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। এই মৌসুমে জেলেরা দলে দলে জাল ও নৌকা নিয়ে নদীতে নামেন। এ বছরও তারা জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে গেছেন। কিন্তু জালে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না। এবার তাদের খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। এ কারণেই ইলিশের মোকাম বলে পরিচিত ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর ও পিরোজপুরের জেলে ও ইলিশ ব্যবসায়ীরা হতাশার মধ্যে সময় পার করছেন।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদীর মধ্যে জেগে ওঠা নতুন চর– এই তিন কারণে নদীতে প্রয়োজনীয় স্রোত নেই। তাই সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে নদীর মোহনায় আসতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ইলিশ। এ কারণেই এই ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না জেলেরা। উপকূলীয় নদ-নদীতে আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। উত্তাল মেঘনা-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েও ইলিশসহ কোনও মাছেরই দেখা মিলছে না জেলেদের জালে।
ইলিশের ‘স্বর্গরাজ্য’ খ্যাত ভোলার তেঁতুলিয়া, পটুয়াখালীর পায়রা, পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা এবং চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এখন ইলিশ মাছ নেই। তবে গত কয়েকদিন সাগরে কিছু ইলিশ ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে। পাড়ের হাটের ইলিশের আড়তদার আফজাল মিয়া বলেন, ‘চলতি শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমার জোয়ারে দেশের নদ-নদীতে ইলিশের দেখা মিলতে পারে। জেলেরা এখন সেই আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন।’
ভোলার ইলিশের ব্যবসায়ী (আড়তদার) মোকাররম হোসেন জানিয়েছেন, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় কিছু জেলে নদীতে সারা বছরই বিভিন্ন মাছের পোনা ধরে। এর মধ্যে ইলিশের পোনাও জালে ধরা পড়ে। এতে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ভরা মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ কম ধরা পড়ার এটিও একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, ইলিশ সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত পাইকারি বাজার ও ইলিশের মোকামগুলোয়। বরিশাল পোর্ট রোডের ইলিশের পাইকারি ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন জানান, প্রতি বছরের ইলিশের মৌসুমে এই আড়তগুলোয় শ্রমিকরা ট্রলার থেকে ইলিশ মাছ ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করে। কিন্তু এ বছরের চিত্র ভিন্ন। এ বছর প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ মিলছে না। তিনি বলেন, ‘গতকাল (০১ আগস্ট) এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯০ হাজার টাকা মণ দরে। এক কেজি সাইজের ইলিশ ৫২ হাজার টাকা মণ দরে ও জাটকার চেয়ে কিছুটা বড় সাইজের ইলিশ প্রতি মণ ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।’
স্থানীয় একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, উপকূলীয় নদ-নদীতে আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। বরিশালের মোকামে গত কয়েক দিনে ইলিশ সরবরাহের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমে গেছে। সংকট দেখা দেওয়ায় বরিশাল মোকামের অনেক শ্রমিক ইলিশ ওঠানো-নামানোর কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। ইলিশ পরিবহনের ট্রলারগুলোয় এখন কাঁঠালসহ অন্যান্য সামগ্রী পরিবহন করছে বলে জানিয়েছেন তারা।
ভোলা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে চর পড়ার কারণে সাগর ও নদ-নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, সাগরে প্রচুর মাছ আছে। আশা করা যায়, শিগগিরই জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়বে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আর দেশের নদ-নদীতে ধরা পড়া মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এর অবদান এক শতাংশ। এক মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় নদীর পরিবেশ, জাটকা সংরক্ষণ ও অভয়াশ্রম নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে বছরে ইলিশের বাণিজ্য হতো কমপক্ষে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ দিতে বছরে দু’বার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ২০১১ সালে সংশোধিত আইন অনুযায়ী ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদ উদয় হওয়ার আগে তিনদিন ও চাঁদ উদয় হওয়ার পরের সাত দিন মোট ১১ দিন উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ দিন।
এছাড়াও জাটকা সংরক্ষণে এবং প্রজননের সুযোগ দিয়ে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই দু’মাসও নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। এ সময়ে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। একজন জেলেকে মাসে দেওয়া হয় ৪০ কেজি চাল। দেশের ১৬টি জেলার প্রায় দুই লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবার এ খাদ্য সহায়তা পায় বলে জানায় মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র। এছাড়া, এই দুই মাস জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ওই সময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলার মদনপুর চরইলিশা থেকে চরপিয়াল হয়ে তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার এবং পদ্মা নদীতে আসে। এ কারণেই চাঁদপুর, লক্ষীপুর, ভোলা ও শরিয়তপুরে মার্চ থেকে এপ্রিল এবং পটুয়াখালী জেলার নদ-নদীতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টনে। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে এ পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর তা ৪ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা ইলিশ সুরক্ষা ও ডিম ছাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করায় এ সফলতা এসেছে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক বলেন, ‘নদীতে ইলিশ আছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন ধরা পড়ছে না, তাতে কী? সময় যখন আছে, তখন ধরা পড়তেই হবে। সামনে শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমা আছে। তখনকার জোয়ারে মাছ আসবে।’
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস