এমটি নিউজ২৪ ডেস্ক : হোটেল মোহছেন আউলিয়া। কেউ ডাকেন গরিবের হোটেল কেউবা ভান্ডারীর হোটেল। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত হোটেলটিতে প্রতি শুক্রবার গড়ে ২শ থেকে ৩শ অসহায়, গরিব, মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার খাওয়ান হোটেল মালিক দেলোয়ার হোসেন ভান্ডারী।
নবী রাসূলের নামে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নিজের ব্যবসার একটি অংশ দিয়েই চালাচ্ছেন এই মেহমান খানা। এমন উদ্যোগে খুশি দিনমজুর, গরিব ও ক্ষুধার্থ মানুষ।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের রিফুজি কলোনির বাসিন্দা সিদ্দিক মিয়ার বড় ছেলে দেলোয়ার হোসেন। সন্তেশপুর দরবার শরীফের ভক্ত হওয়ায় এলাকার সবাই ডাকে ভান্ডারী নামে।
১৬ বছর আগে ঢাকার সায়েদাবাদে একটি হোটেল থেকে খাবার না দিয়ে একজন পাগল ফকিরকে বের করে দিতে দেখে গরিব, অসহায় ও ভিখারীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা জন্মে তার মনে। নিজের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হলে প্রতি শুক্রবার গরিব অসহায়দের জন্য বিনামূল্যে খাবারের এই উদ্যোগ চালু করেন তিনি।
আট মাস আগে প্রতি শুক্রবার ৫০ জনের খাওয়ানোর চিন্তা নিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে ২শ থেকে ৩শ মানুষ বিনামূল্যে খাওয়ানো হয় এই হোটেলে।
এমন মহৎ কাজের উদোক্তা দোলোয়ার হোসেন ভান্ডারী জানান, জীবনের শুরুতে অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। রিকশাচালক থেকে শুরু করে হোটেল বয়, পরে বাবুর্চি সবশেষ বাসের হেলপার ও চালকের কাজ করেন।
চাকরির কিছু টাকা সঞ্চয় করে ছোট পরিসরে চালু করেন নিজের এই হোটেল ব্যবসা। তবে সন্তেশপুর দরবার শরীফের ভক্ত হওয়ার পর হোটেলের নাম রাখেন হোটেল মোহছেন আউলিয়া। গরিব-দুঃখী অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের কথা চিন্তা করে সপ্তাহে একটি দিন অন্তত যাতে তারা ভালো খেতে পারে সেজন্যই তার এই প্রচেষ্টা।
তিনি বলেন, আমি লোক দেখানোর জন্য এগুলো কিছু করি না। আমার নবী রাসূলের নামে আমি যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি পাই তাই গরিব, অসহায়, ফকিরদের জন্য এই খাবারের ব্যবস্থা করা।
এই কাজে আমি কারো সহযোগিতা নিই না। আল্লাহ আমাকে যতদিন তৌফিক দেন আমি ততদিন এভাবেই মানুষকে খাবার দিয়ে যাবে। আমার হোটেলে যদি ৫শ মানুষও আসে আমি তাদের খাওয়াবো ইনশাআল্লাহ।
হোটেলে যারা খেতে আসছেন তাদের কেউ রিকশাচালক, কেউ ভিক্ষুক কেউবা আবার দিনমজুর। এছাড়াও আশপাশের মাদরাসা ও এতিমখানা থেকেও আসছে। একটু ভালো খাবার খাওয়ার আশায় প্রতি শুক্রবার তাদের ছুটে আসা।
শুক্রবার (৫ আগস্ট) সরেজমিনে হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে চলছে রান্নার কাজ। হোটেলের কর্মরত স্টাফরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি করছেন খাবার।
পরে জুমার নামাজের শেষেই দেখা গেলো অসহায়, গরিব, ফকির ও মাদরাসার এতিম ছাত্ররা আসতে শুরু করেন হোটেলে। সবাই যে যার মতো বসে পড়তে থাকেন হোটেলের চেয়ারে। কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় খাবার বিতরণ। হোটেলে স্টাফরা সবাই একত্রিতভাবে খাবার পরিবেশন করেন আনন্দের সঙ্গে।
মাদরাসার কয়েকজন এতিম শিক্ষার্থী বলেন, আমরা এর আগেও বেশ কয়েকবার এই হোটেলে এসেছি। এখানে আসলে কোনো শুক্রবার মুরগির মাংস, কোনো শুক্রবার গরুর মাংস, মাছ সঙ্গে ডাল দিয়ে খাবার দেয়। আমাদের অনেক ভালো লাগে।
রিকশাচালক রাসেল গাজী, সবুজ হোসেনসহ কয়েকজন জানান, আমরা জানি প্রতি শুক্রবার এখানে আল্লাহর ওয়াস্তে খাবার দেয়। তাই আমরা শুক্রবার চলে আসি। অন্য হোটেলে গেলে একশ থেকে দুইশ টাকার মতো লেগে যেত। কিন্তু ভাই আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকা রাখে না। তাই চলে আসি।
হোটেলের বাবুর্চি মো. আল-আমিন প্রধানীয়া, সাহয্যকারী মো. মাসুদ ও মো. ইমন জানান, শুধু শুক্রবার নয় এখানে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন গরিব অসহায়কে আল্লাহর ওয়াস্তে খাওয়ানো হয় এবং এজন্য হোটেল কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া আছে মালিক কর্তৃপক্ষের।
তারা বলেন, মালিক পক্ষের এমন উদ্যোগে অনেক খুশি তারা। যদিও গরিব বলে এমন মহৎ কাজে আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেন না তারা। তবে শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে পাশে থাকতে পেরে খুশি।
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক কামরুল সরকার সঈদ বলেন, দেলোয়ার হোসেনের এমন উদ্যোগটি ইতোমধ্যে উপজেলায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
তার এমন কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। তার কারণে আমাদের এলাকার অনেক অসহায় গরিব ও ক্ষুধার্থ মানুষ সপ্তাহে অন্তত একদিন ভালো খাবার খেতে পারছে।
তারা বলেন, আমাদের সমাজে এমন অনেক কোটিপতি আছে যাদের অঢেল সম্পত্তি থানা সত্ত্বেও এমন উদ্যোগ নেন না। তাই দেলোয়ার হোসেনের এমন উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ। তারা প্রত্যাশা দেলোয়ার হোসেনকে দেখে এমন কাজে এগিয়ে আসবেন সমাজের বিত্তবানরা।
ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন দেলোয়ার হোসেনের বাবা সিদ্দিক মিয়া। দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে আসেন চাঁদপুরে। বাবার খোঁজে ১৯৮৫ সালে বড় ছেলে দেলোয়ার হোসেনও চলে আসেন এখানে। সেই থেকে এখানে স্থায়ী বসবাস। তবে সৃষ্টিকর্তা চাইলে সারাজীবন এভাবেই গরিব অসহায় মানুষের খেদমত করে পাশে থাকতে চান তিনি।-জাগো নিউজ