নুরুজ্জামান লাবু: সাদাকাত বিন মমিনের বয়স আট বছর। আজ মায়ের সঙ্গে বনানীর সামরিক কবরস্থানে এসে তার চোখ টলমল। বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অস্ফূট স্বরে বলছে, ‘ওদের জন্য আমি আমার বাবাকে দেখতে পেলাম না।’ জন্মের পর বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি সাদাকাতের। পিলখানা ট্রাজেডির ১১ দিন পরে জন্ম নেয় সে। ওই হামলার ঘটনায় নিহত মেজর মোমিনুল ইসলামের ছেলে সে।
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল পিলখানা ট্রাজেডির ৮ বছর। ২০০৯ সালের এই দিনে (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) পিলখানায় বিডিআর-এর (বর্তমানে বিজিবি-বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এসময় তারা অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটও করে করে। ওই দু’দিনে তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও নারী-শিশুসহ আরও ১৭জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পিলখানা ট্রাজেডির ৮ বছর পূর্তিতে সকালে বনানীর সামরিক কবরস্থানে নিহতদের স্মরণে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, বিজিবি প্রধানসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও পরিবারের পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সকাল ৯টার দিকে কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা শুরু হয়। এর আগে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বিউগল বাজিয়ে ও স্যালুটের মাধ্যমেও জানানো হয় শ্রদ্ধা। তারপর স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সবাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আবুল হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বনানী সামরিক কবরস্থানে এক তরুণ ও কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে একটি কবরের সামনে দাঁড়ালেন লাঠি হাতে আসা ষাটোর্ধ্ব এক নারী। সেখানে বসে থাকলেন বেশ কিছুটা সময়। কাঁদলেন, দোয়া করলেন তারপর আবার ফিরতে শুরু করলেন প্রধান ফটকের দিকে। ষাটোর্ধ্ব ওই নারীর চোখে তখন পানি। তরুণ ও কিশোর ছেলে দুটির চোখে-মুখে বেদনার ছাপ। তারা হাঁটছিলেন ধীর পায়ে। কাছে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই সেই বৃদ্ধার কান্নার যেন বাঁধ ভেঙে গেলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমি এক দুঃখিনী মা, ৮ বছর ধরে বুকে কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি। ৮ বছর আগে আমার নিষ্পাপ, নির্দোষ ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে।’ আলাপচারিতায় জানা গেলো তার নাম কোহিনুর বেগম।পিলখানা ট্রাজেডিতে নিহত মেজর মিজানুর রহমানের মা তিনি। মিজানুরের দুই সন্তানকে নিয়ে পিলখানা ট্রাজেডির দিকে কবর জিয়ারত করতে এসেছিলেন তারা।
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো ও কবর জিয়ারত শেষে নিহত মেজর মিজানের মায়ের সঙ্গে ফিরছিলেন তার দুই সন্তান তাহসিন রহমান রামি ও ফারদিন রহমান সামিও। রামি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়েন। আর ১১ বছরের সামি পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে বনানীর একটি স্কুলে। ৮ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রামি বলেন, ‘সেদিন সকালে বাবার (মেজর মিজান) নতুন র্যাঙ্ক পড়ার কথা ছিল। সকালে বাবা যখন নাস্তা করে বাসা থেকে বের হন। তখন আমার সঙ্গে কথা হয়। আমি তাকে বিদায় জানাই। সেদিন আমাদের জন্য ছিল শুভ দিন। কিন্তু সেটা হয়ে যায় অশুভ। র্যাঙ্ক পড়ার বদলে তিনি দুই দিন পর ফিরেন লাশ হয়ে।’
অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়েন রামি। চোখ মুছে আবার বলতে থাকেন, ‘এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো। এই ঘটনার দোষীরা এখনো শাস্তি পেলো না। এই ঘটনা কেন ঘটলো তাও আমরা জানতে পারলাম না। একটি ঘটনা তো আর এমনি এমনি হয় না। কেউ আমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। আমার জানার খুব ইচ্ছা কেন আমার বাবাকে হত্যা করা হলো?’ পিলখানায় রামি-সামির বাবার নির্মম মৃত্যুর নয় মাস আগে মাকে হারান তারা। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মা রেবেকা ফারহানা রোজী। এখন দাদা-দাদির সঙ্গেই থাকেন দুই ভাই। পিলখানার ঘটনার সময় সামীর বয়স তিন বছর। ফলে তার সেই স্মৃতি আর মনে নেই। তবে রামির হৃদয়ে গেঁথে আছে বেদনাসিক্ত সেই সময়ের প্রতিটি মুহুর্ত। সামি বলেন, ‘আমি ক্যাডেট কলেজে পড়ছি। আমার ইচ্ছা আমি আর্মিতে জয়েন করার। আমি আমার বাবার মতো হতে চাই।’
রামি-সামির মতোই বাবার কবর জিয়ার করতে মা সানজানা সোনিয়ার সঙ্গে এসেছিলেন ৮ বছরের সাদাকাত বিন মমিন। পিলখানা ট্রাজেডিতে নিহত মেজর মোমিনুল ইসলামের ছেলে। জন্মের পর বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। পিলখানা ট্রাজেডির ১১ দিন পর জন্ম হয় তার। মা সানজানা সোনিয়া বলেন,‘বাবার ছবি দেখে ও গল্প শুনে সে বুঝে গেছে তার বাবার কী হয়েছে। এজন্য মাঝে মধ্যেই সে বলে আমি বড় হয়ে অফিসার হবো তারপর ওদের গুলি করে মারবো।’
নিহত মেজর মমিনুলের বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে হারিয়েছি, ছেলেকে তো আর কোনওদিন ফিরে পাবো না। কিন্তু বিচারটা দেখে যেতে পারলে মনে শান্তি পেতাম।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কীভাবে দিনাতিপাত করছি আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না।’ কান্নাজড়িতকণ্ঠে মোমিনের বোন মেহেরুন্নাহারও বলেন একই কথা। শহীদ সৈনিক জহিরুল ইসলামের স্ত্রী ফারজানা আফরিন বলেন, ‘আমরা শুধু হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এর বেশি আমাদের কোনও চাওয়া নেই।’ নিহত কর্নেল কিবরিয়ার ছোট ভাই জাফর আহমেদ বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা বাকরুদ্ধ। আমরা বছরের পর বছর কষ্ট বুকে নিয়ে আছি। আর যেন কোনও শৃঙ্খলা বাহিনীতে এমন কোনও ঘটনা না ঘটে। আমরা যেন এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দেখতে পাই, এই আমাদের প্রত্যাশা।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহত কর্নেল কুদরত-ই-এলাহীর বাবা হাবীবুর রহমান। বলেন, ‘আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আমার সন্তান সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছিল। সন্তান হারিয়ে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারি না।’
এদিকে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘পিলখানা ট্রাজেডির ঘটনায় পলাতকদের খুঁজে বের করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খুঁজে বের করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে।’ পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি দুঃখের একটি দিন। এই ঘটনার এখনো বিচার চলছে। কিন্তু ঘটনার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। মূল পরিকল্পনাকারী বা নেপথ্য নায়ক কে? তারা কোথায়? তাদের খুঁজে বের করে এই ঘটনার ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের দাবি জানান তিনি।-বাংলা ট্রি্বিউন
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এইচএস/কেএস