নিউজ ডেস্ক: ‘মাগো আমরা অনেক বিপদে আছি, আমাদের বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) জওয়ানরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে। আমরা কজন লুকিয়েছি মা। জানি না কী হবে। আমার জন্য দোয়া করো যেন জীবন নিয়ে তোমার কাছে ফিরতে পারি।’
জিম্মি অবস্থায় শেষবারের মতো মুঠোফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আবেগতাড়িত কণ্ঠে মা মোমেনা বেগমের সঙ্গে এসব কথা বলেন কর্নেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন।
মাকে খুব ভালোবাসতেন কর্নেল মোয়াজ্জেম। চাকরির সুবাদে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকতেন মোয়াজ্জেম হোসেন। কিছুদিন পর মাকেও ঢাকার গাবতলী মাজার রোডের বাসায় নিয়ে আসেন। সবকিছুই ভালোই চলছিল। হঠাৎ ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে (তৎকালীন বিডিআর) জওয়ানরা হামলা চালায়। নিহত হন ৫৩ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। এদের মধ্যে কর্নেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেনও ছিলেন।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের আট বছর উপলক্ষে আজ শনিবার রাজধানীর বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামরিক সচিব, তিন বাহিনীর প্রধান ও বিজিবির মহাপরিচালক। এরপর শহীদ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা একে একে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। শহীদদের স্মরণে ও বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
ফুল হাতে কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনের কবরের সামনে যান মা মোমেনা বেগম। সঙ্গে ছিলেন মোয়াজ্জেমের স্ত্রী বদরুন্নেসা ও বোন সালমা বেগম। ফেরার পথে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে।
মা মোমেনা বেগম জানান, মোয়াজ্জেম আমাকে খুব ভালোবাসত। পেশাগত কারণে সবসময় বাসায় আসতে পারতো না। কখনো কখনো দু-তিনদিন পরপর পিলখানা থেকে গাবতলীর বাসায় আসতো।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগের রাতের ঘটনা। রাতে আমরা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি। বের হয়ে যাওয়ার সময় মোয়াজ্জেম বলে, ‘মা আমাকে কয়েকটা পান বানিয়ে দাও। কাল কাজের কারণে আমার ফেরা নাও হতে পারে। স্বযত্নে পান বানিয়ে দিই। একটা মুখে দিয়ে বাকি পান হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে মোয়াজ্জেম। পরদিনই পিলখানার ঘটনা।
মা মোমেনা বলেন, পরের দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফোন করে ছেলে। ফোন রিসিভ করেই শুনি মোয়াজ্জেমের ভয়ার্ত কণ্ঠ। বলে, ‘মা আমরা বিপদে আছি, বিডিআর জওয়ানরা আমাদের জিম্মি করেছে, আমরা কজন লুকিয়ে আছি। দোয়া করো যেন জীবন নিয়ে তোমার কাছে ফিরতে পারি। কিন্তু আর ফেরা হয়নি। জানি না আমার সবগুলো পান মোয়াজ্জেম খেতে পেরেছিল না?’
কর্নেল মোয়াজ্জেমের মা বলেন, ‘এসব আর লিখে কী করবা বাবা, কী আর হবে, আমার সন্তান কি আর ফিরবে? আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার মোয়াজ্জেম যেন ভালো থাকে।’
স্বামী সম্পর্কে শাশুড়ির কথা শুনে ডুকরে কেঁদে ওঠেন স্ত্রী বদরুন্নেসা। বলেন, ‘ওমন করে মোয়াজ্জেমরা জিম্মি হয়ে পড়তে পারে ভাবতে পারি না। এখনো ওর সেই কণ্ঠ ভেসে ওঠে।’ সেদিন সে (স্বামী) আমাকে বলেছিল, ‘বদরুন্নেসা- আমাকে ক্ষমা করে দিও, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করে দিও, জানি না ফিরবো কি না, জওয়ানরা হামলা করেছে। লুকিয়ে আছি। অনেককে মেরে ফেলেছে। হয়তো আমাকেও ওরা মেরে ফেলবে। দোয়া করো যেন জীবন নিয়ে ফিরতে পারি।’
বোন সালমা বলেন, ভাবি ও মা’র খুব কষ্ট হচ্ছে। মায়ের বয়স হয়েছে। ভাই মোয়াজ্জেম নেই। ওর বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা করছে। ছোট ছেলে আর্মি অফিসার। কেউ সময় দিতে পারে না।
ছেলে কাজী সাদির বলেন, দোয়া করবেন যেন আমার বাবা ওপারে ভালো থাকেন, আমার মা-দাদি আজও বাবার স্মৃতি নিয়ে বেড়ান। সবার দোয়া চাচ্ছি তারা যেন বাকি সময়টা সুস্থ থাকেন।-জাগো নিউজ
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এইচএস/কেএস