ওমর ফারুক: ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের দু’বছর পূর্ণ হল বৃহস্পতিবার। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এদিন মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন ঢাকা দক্ষিণে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এবং ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক। নির্বাচনে দু’জনই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভাজিত করার পর তারা দু’জনই হলেন ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর নামে বিভক্ত সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র।
মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ৬ মে আনিসুল হক এবং ৭ মে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নিজ নিজ করপোরেশনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ হিসেবে আর ক’দিনই পরই তাদের তিন বছরে পদার্পণ হবে। তাই নগরবাসীর জন্য গত দু’বছর কি করেছেন মেয়ররা এমন প্রশ্ন এ মুহূর্তে ঢাকাবাসীর মুখে মুখে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভাজিত করার পর প্রায় সাড়ে চার বছর যে ঢিলেঢালা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, মেয়রদের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেটা কেটে যায়। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় দায়িত্ব নেওয়ার বছরটি তাদের কেটে যায় সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝে উঠতে ও পরিকল্পনা করতে। পাশাপাশি প্রথম বছরজুড়ে বিভিন্ন ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এবং নগরবাসীর সামনে হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হয়ে আশ্বাসের ফুলঝুড়ি ফোটান তারা। ফলে সমস্যা চিহ্নিতকরণ শুরু হলেও সেগুলো নির্মূলে প্রথম বছরটিতে কার্যত তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি।
দুর্ভোগ কবলিত মানুষের মনেও স্বস্তি ফিরে আসেনি। তবে নাগরিকদের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে প্রথম বছরে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের চেয়েও দক্ষিণের মেয়র আনিসুল হক বেশি পারঙ্গমতার পরিচয় দেন।
তবে পরবর্তীতে ঢাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। দ্বিতীয় বছরে দেখা যায়, বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে তিনি নাগরিকদের অভিযোগ শুনছেন, সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। গুলিস্তানের ফুটপাতকেও হকারমুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি।
তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি দলীয় নেতাদের হকারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সমালোচিত হন তিনি। আর হকারদের একটি বড় অংশ শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকার সুবাদে তার এই উদ্যোগ আধাবেলার বেশি টেকেনি। তবে এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগ গ্রহণ এবং হকারদের কী করে পুনর্বাসনের মাধ্যমে গুলিস্তানের ফুটপাথ থেকে সরানো যায় সে বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব রেখেছেন তিনি।
সবশেষ, গুলিস্তানের কাছেই মহানগর নাট্যমঞ্চটিকে হকার পুনর্বাসনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব রেখেছেন মেয়র সাঈদ খোকন, তবে এ উদ্যোগ এখনও বাস্তাবায়িত হয়নি। এদিকে, পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের গুদামগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সম্প্রতি দক্ষিণের মেয়রের নির্দেশে সেখানে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু কেমিক্যালের গুদাম উচ্ছেদ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্মীরা। এছাড়াও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কয়েকদিন লক্কড়-ঝক্কর বাসের বিরুদ্ধে অভিযানও পরিচালনা করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
তবে দু’বছরের তুলনামূলক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। ঢাকাকে সবুজ নগরী হিসেবে গড়ার ঘোষণা দিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাস্তাগুলোর পাশে টবে গাছের চারার ব্যবস্থা করা ও বিভিন্ন দেয়ালে নগরীর সৌন্দর্য বাড়াতে নানা ধরনের লতানো গাছের চারা লাগানোর ব্যবস্থা করে প্রশংসিত হন তিনি।
তবে মেয়র আনিসুল হকের গত দুই বছরের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হচ্ছে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সরানো ও গাবতলীর একটি সড়ক হকার ও অবৈধ দখলমুক্ত করা। ক্ষমতাধর বিভিন্ন পক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে সড়ক চালু করা ও গাবতলীর একটি সড়ককে অবৈধ দখলদার মুক্ত করে জনসাধারণের চলাচলের জন্য উপযোগী হিসেবে তৈরি করে তিনি সবমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
এছাড়াও গাবতলীর একটি কবরস্থান সরিয়ে উত্তরা ও রূপনগরের দু’টি সড়ক প্রশস্ত করিয়েছেন তিনি। সড়কের দখল হয়ে যাওয়া জায়গা পুনরুদ্ধারে এখন নিয়মিতভাবেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মেয়র আনিসুল হকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে, কূটনৈতিক পাড়া গুলশানসহ বনানীর নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকেই গুলশান ও বনানীর নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি।
এজন্য গুলশান এলাকায় নিয়ন্ত্রিত নিবন্ধিত রিকশা চলাচল চালু এবং গুলশানের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের রুট পারমিট বাতিল করে শুধুমাত্র গুলশান-বনানীতে চলাচলকারী ঢাকা চাকা নামের আলাদা বাসের ব্যবস্থা করেন তিনি উত্তর সিটি করপারেশনের ব্যবস্থাপনায়।
বর্তমানে গুলশান কূটনৈতিক পাড়ায় বিভিন্ন দূতাবাসের সামনে নিরাপত্তার নামে তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার অপসারণ অভিযান চলছে। নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। নতুন ঢাকার তেজগাঁও, মহাখালী, গুলশান, বনানী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস নির্মাণ করা হয়েছিল। মেয়রের নির্দেশে সেগুলোও উচ্ছেদ করা হয়েছে।
রাজপথে এক সময় সোডিয়াম বাতি জ্বলত। এখন দুই সিটিতেই জ্বলছে ডিজিটাল এলইডি বাতি। রাজপথ থেকে বর্জ্যের স্তূপ পুরোপুরি সরেনি, তবে আগের চাইতে কমেছে। কমেছে অবৈধ বিলবোর্ডের উৎপাত।
তবে, বর্তমানে যে দু’টি সমস্যা পুরো নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে পীড়া দিচ্ছে সেগুলো হলো ভাঙা রাস্তা ও জলাবদ্ধতা। বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে থাকা এসব সমস্যার যেন শেষ নেই। এমনকি দুই মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা আশ্বাস দিলেও শেষ হয়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুই সিটির প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডের কোনও না কোনও রাস্তা ভাঙা। ঢাকা উত্তরের উত্তরা, খিলক্ষেত, লেকসিটির প্রবেশ সড়ক, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মগবাজার, রামপুরা এবং ঢাকা দক্ষিণের যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ, ইসলামবাগ, মিরহাজীর বাগ প্রভৃতি এলাকার রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে।
এছাড়া সামান্য বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার শিকার হয় রাজাবাজার, শুক্রাবাদ, মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, রামপুরা, লক্ষ্মীবাজার, মালিবাগ, মেরুল বাড্ডা, পূর্বদোলাইরপাড়, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকা।
উন্নয়ন কাজের এই বেহাল দশা প্রসঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, ঠিকাদাররা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ নেওয়ার পর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। সরকার দলীয় বলে কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ তারা মানেন না। শান্তিনগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ সময়মতো না হওয়ায় এক ঠিকাদারের কাজ বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশন তা পারেনি।
মশক নিধনে প্রতিবছর অন্তত ১০ কোটি টাকার বাজেট করা হলেও দুই সিটির সবখানে এই কার্যক্রম দেখা যায় না বলে নগরবাসীর অভিযোগ। হাতের বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য দুই সিটি প্রায় দশ হাজার ওয়েস্টবিন স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনা অভাব ও নগরবাসীর অসহযোগিতায় তা ব্যর্থ হয়েছে।
দু’বছরের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলার জন্য বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হককে পাওয়া যায়নি। সিটি করপোরেশনের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মনজুর-ই-মওলা জানান, মেয়র বিদেশ সফরে রয়েছেন। আগামী মাসের ৪ তারিখ ঢাকা ফিরবেন।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। শিগগিরই এর সুফল দেখা যাবে। তিনি বলেন, দু’বছরে কী করেছি তার বিচারের দায়িত্ব নগরবাসীর।
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এরপরেও আমরা কাজ করছি। শান্তিনগর এলাকায় আগামী জুনের মধ্যে ৮৫ ভাগ জলাবদ্ধতা কমবে। অন্যান্য এলাকায়ও কাজ চলছে। তিনি বলেন, ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনের ড্রয়িং-ডিজাইন নেই। ড্রেনের কোথাও জ্যাম হলে আমরা পানির পেছনে দৌড়াই। ড্রেনের নকশা থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম।
মেয়র বলেন, দুই বছরে ৩০০টি সড়ক উন্নয়ন করেছি। নগরজুড়ে ৩৭ হাজার এলইডি বাতি লাগানোর কাজ চলমান রয়েছে। জুন-জুলাইয়ের মধ্যে পুরো ঢাকায় আধুনিক এলইডি বাতি জ্বলবে। ফুটপাত দখলমুক্ত করেছি। অবৈধ যানবাহন ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা টার্গেটে পৌঁছতে পারিনি। তবে যে অবস্থান থেকে কাজটা শুরু করেছি তা থেকে অনেক দূর এগিয়েছি।বাংলা ট্রিবিউন
২৮ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/টিটি/পিএস