সোমবার, ১৫ মে, ২০১৭, ১১:০০:২৮

গলায় গলায় ভাব ছিল অথচ এখন নাঈমকে চেনে না তারা!

গলায় গলায় ভাব ছিল অথচ এখন নাঈমকে চেনে না তারা!

নিউজ ডেস্ক: নিজের অপকর্মের পথ প্রশস্ত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান গড়তে চেয়েছিল বনানীর নির্যাতন মামলার আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হাসান মোহাম্মদ হালিম। এ লক্ষ্যে সে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিল। এ ছাড়া ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। পরে কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পদও বাগিয়ে নেয়। সিরাজগঞ্জে ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছে। তবে সম্প্রতি নির্যাতনের অভিযোগ প্রকাশের পর নেতারা তাকে না চেনার ভান করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই প্রতারণাসহ নানা অপকর্মে সিদ্ধহস্ত নাঈম। কাজীপুরে নিজের এলাকায় প্রতারণার অভিযোগে গ্রাম্য সালিসে একাধিকবার শাস্তিও পেতে হয় তাকে। একপর্যায়ে এলাকা ছাড়তে হয়। গত কয়েক বছরে ঢাকায় নানা প্রতারণার মাধ্যমে বিত্তবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়। এরপর নিজের এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কৌশল নেয় নাঈম।

সে লক্ষ্যে প্রায় বছরখানেক আগে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। জিহাদের মাধ্যমে পরিচিত সে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম লিমন এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জামাত আলী মুন্সির ছেলে ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সক্রিয় কর্মী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। এসব নেতার মাধ্যমে সে জেলা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে।

জানা যায়, গত ৪ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস স্মরণে কাজীপুর উপজেলার গান্ধাইল বাজারে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয়ে ব্যানার ও ফেস্টুন টানানোর ব্যবস্থা করে নাঈম। এর পর সে বিভিন্ন দিবসে সাংগঠনিক পরিচয়ে অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন টানায়। এ সময় সে সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছে।

গত বছরের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের পর দলের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে স্থান পাওয়া সিরাজগঞ্জের ছয় নেতাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সদর উপজেলার সায়দাবাদে ওই অনুষ্ঠানে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলামসহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে যোগ দেয় নাঈম।

গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সিরাজগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটে জিহাদের দল সিরাজগঞ্জ টাইগার্সের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হয় নাঈম। এরপর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম লিমন, সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এস আশফাক, কলাবাগান ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাছান ফারুকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও সুসম্পর্ক তৈরি করে নাঈম। সে এসব নেতাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে থাকে।

সিরাজগঞ্জ জেলা যুবলীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘হুট করেই নাঈম সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। সে যখন ঢাকা থেকে আসত তখন সিরাজগঞ্জের যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাকে সময় দিত। সংগঠনের কার্যালয়ে নাঈম সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারের পাশেই বসত। আবার সিরাজগঞ্জের ওই সব নেতা ঢাকায় গেলে নাঈম তাঁদের সময় দিত, নেতাদের অনেক আবদার পূরণ করত। ’

সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জিহাদের মাধ্যমে নাঈম কাজীপুর উপজেলা কমিটিতে সহসভাপতি পদ পায়। জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে নাঈমের সুসম্পর্কের কারণে তখন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা জোরালো আপত্তি জানাতে সাহস পাননি। এখন নিজেকে বাঁচাতে জিহাদসহ অন্যরা নাঈমের দলীয় পরিচয় অস্বীকার করছেন। ’

তবে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক সাইফুল ইসলাম  বলেন, ‘নাঈম সিরাজগঞ্জে দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল না। তাকে আমি শুধু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর জাতীয় নেতাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। তবে সে সংগঠনের কোনো পদে নেই। ’

সংগঠনের পদে না থাকলে সাত-আট মাস ধরে সাংগঠনিক পরিচয়ে নাঈম আশরাফ ওরফে হালিমের ব্যানার, ফেস্টুন টানানো আছে কেন—জানতে চাইলে সাইফুল বলেন, ‘কাজীপুর উপজেলা কমিটির পরিচিতি সভা এখনো হয়নি। এ কারণে হয়তো স্থানীয় নেতাদের অনেকেই হালিমের বিষয়টি ক্লিয়ার হতে পারেননি। ’
জেলা ছাত্রলীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘নাঈম আশরাফ ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিষয়েও হস্তক্ষেপ করেছে। সে তার নিজের পছন্দের ছেলেকে কমিটিতে রাখতে আমাদের অনুরোধ জানিয়েছিল। ’

কাজীপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাহারুল ইসলাম  বলেন, ‘উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয়ে ব্যানার-ফেস্টুন টানানোর পর যুবলীগের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে সময় ব্যানার-ফেস্টুনগুলো অপসারণ করা হয়নি। ’

ইন্টারনেটে ছবি আদান-প্রদানের ওয়েবসাইট ইনস্টাগ্রামে নাঈম আশরাফের আইডি ঘেঁটে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী অনেক নেতার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার অংশ নেওয়ার অসংখ্য ছবি রয়েছে। সেখানে নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত মুহূর্তের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ছবিও পোস্ট করেছে নাঈম। সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম লিমন, ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এস আশফাক, কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ফারুকের সঙ্গে বিভিন্ন ছবি পোস্ট করেছে নাঈম।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জেলা কমিটির নেতারা সাধারণত উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। অন্য পদগুলোতে যারা আছে তাদের বেশির ভাগকেই আমরা চিনি না। নাঈম আশরাফ বা হালিম নিজের অপকর্মকে আড়াল করার জন্যই কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় ব্যবহার করেছে। আসলে সে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেউ নয়। ’

স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেউ না হওয়ার পরও নাঈম আশরাফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে জিহাদ আল ইসলাম বলেন, ‘সিরাজগঞ্জে শিশু নির্যাতন ও যৌতুকবিরোধী একটি কনসার্ট আয়োজনের বিষয়ে সে আমার সহযোগিতা চায়। তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। সে কনসার্টে সিরাজগঞ্জ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর কিছুদিন পরে আমরা সিরাজগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। সে সময় আমি তার কাছে স্পন্সর জোগাড় করে দেওয়ার সহযোগিতা চাই। খেলা চলাকালে সে সিরাজগঞ্জে এসেছিল, তখন দুইবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ’

নির্যাতন মামলার পর নাঈম যোগাযোগ করেছিল কি না জানতে চাইলে জিহাদ বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ হয়নি, সে প্রশ্নও আসে না। তাকে কোথাও পেলে আইনের হাতে সোপর্দ করব। সে হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই আমাদের ব্যবহার করেছে। এটি এখন আমরা বুঝতে পারছি। ’
নাঈমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম লিমন বলেন, ‘তাকে আমি চিনতাম না। সিরাজগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট খেলার সময় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ ভাইয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরে তার সঙ্গে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে কয়েকবার দেখা হয়। ’

লিমন বলেন, ‘নাঈম যে এত ধুরন্ধর তা আগে বুঝতে পারিনি। তার আসল পরিচয় জানতে পারলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতাম না। সে অপকর্ম আড়াল করার জন্যই সিরাজগঞ্জের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আমরা অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার চাই। ’

ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা যায় কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ফারুককে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে নাঈম ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘নাঈমের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। সে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল এটা সত্য। আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এস আশফাক, ছাত্রলীগের নেতা দীপ ইউনুস ও সিরাজগঞ্জের জিয়াউর রহমান নামে এক কর্মীর সঙ্গে সে এসেছিল। ’

জানতে চাইলে ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এস আশফাক বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের অনেক নেতাকর্মীই আমার সঙ্গে দেখা করে থাকে। সেভাবেই একদিন সে (নাঈম) আমার কাছে এসে পরিচিত হয়। এরপর একদিন আমার সঙ্গে কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সভাপতির জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে যায়। তবে নাঈমের সঙ্গে আমার তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ’
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে