ঢাকা: রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়ার কালিয়ারটেকে তিন সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুটার দিকে একটি কক্ষ থেকে তিন সন্তানের ও অন্য কক্ষ থেকে তাদের মায়ের লাশ উদ্ধার করে। অভাব অনটনের কারণে তিন সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক ধারণা করছে পুলিশ। তবে মৃতদের স্বজনদের দাবি, এটি সাজানো ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
মৃত ব্যক্তিরা হচ্ছে, এন এম আখি শান্তা (১৩),আর এম আরিশা (৯), মো. মোছামিম সাদ (১১মাস) ও তাদের মা রেহানা পারভীন (৩৪)।
শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, একতলা টিনশেড বাড়ির তিনটি কক্ষে বসবাস করতেন মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী রেহানা পারভীন ও তাদের তিন সন্তান। বাড়ির অন্যপাশে থাকেন মোস্তফা কামালে বোন কোহিনূর ও তার স্বামী। এছাড়া বাড়িটিতে আরও চারটি কক্ষে দুজন করে ভাড়াটিয়া রয়েছে।
প্রতিবেশী ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইফতার শেষে স্থানীয় ‘যুব কল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কোঅপারেটিভ’ নামে একটি সমিতির অফিসে যান মোস্তফা কামাল। রাত ১২টার দিকে তিনি বাসায় ফিরে দেখতে পান, একটি কক্ষের বিছানায় পড়ে আছে তিন সন্তানের লাশ ও অন্য কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন তার স্ত্রী। মোস্তফা কামালের চিৎকার চেচামেচিতে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। স্ত্রীকে নিচে নামিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে রাত ১টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে আসে তুরাগ থানা পুলিশ।
নিহতদের সুরতহাল প্রস্তুত করেন তুরাগ থানার এসআই খগেন্দ্র চন্দ্র সরকার। সুরতহালে বলা হয়েছে, রাত ১২টা ১০ মিনিটে বাসায় আসেন মোস্তফা কামাল। কিন্তু অনেক ডাকাডাকির পরও ভেতর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজার পাশে জানালা দিয়ে কৌশলে দরজার সিটকিনি খোলেন তিনি। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখেন, তিন সন্তানের নিথর দেহ খাটের ওপর পড়ে আছে। স্ত্রী রেহানা পারভীনের দেহ অন্য রুমে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত ছিল। সন্তানদের প্রত্যেকের গলায় আলাদা আলাদা ওড়না দিয়ে গিট দেওয়া ছিল। শুধু বড় মেয়ের পা বাধা ছিল।
তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবে-ই-খোদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হচ্ছে, তিন সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। তবে নিহত শিশুদের বাবার কাছ থেকে যতটুকু জানা গেছে, পরিবারে অস্বচ্ছলতা ছিল। অভাব-অনটনের কারণে সন্তানদের চিকিৎসা ও পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছিলেন না তিনি।
মোস্তফা কামালের প্রতিবেশী ওয়ার্কশপ কর্মী মো. কামাল বলেন, ‘উনার অবস্থা আগে ভালো ছিল।বাড়িটা উনিই করেছেন। কিছুদিন হলো তার বোন এখানে এসেছেন। সংসারে অনটন ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কখনও শেয়ার করতেন না।’
তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতেও তার (মোস্তফা কামাল) সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি রাত সোয়া ১১টার দিকে ভাত খেয়ে চা খেতে বাইরে যাই। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয়। চা খাওয়া শেষে আমরা একসঙ্গে রওনা দেই। কিন্তু আমি একটু দ্রুত চলে আসি। টয়লেটে যাওয়া জরুরি ছিল। বরাবরই তিনি বাসার সামনে একটি সিগারেট ধরিয়ে সেটা শেষ করে বাসায় ঢোকেন। বাসার ভেতরে তিনি সিগারেট খেতেন না। আমি হাতমুখ ধুয়ে মাত্র বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখি, উনি (মোস্তফা) চিৎকার করছেন। ভেতরে ঢুকে লাশ দেখে আমার মাথা ঘুরে যায়, তাই আমি চলে আসি।’
কামাল আরও জানান, বর্তমানে তিনি (মোস্তফা কামাল) তেমন কিছু করতেন না। তার হাতের লেখা সুন্দর। আমাদের একটা সমিতি আছে ‘যুব কল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কো-অপারেটিভ।’ উনি সেখানে বই লেখার কাজটা করতেন। এই সমিতিতে তারও শেয়ার রয়েছে।’
প্রতিবেশী আছমা বেগম বলেন, ‘আমি রাতে খবর পেয়ে দেখতে এসেছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে যায়। তখন আমি দেখতে পাই, মাঝখানের কক্ষে খাটের ওপর সবার ডানে পড়ে ছিল বড় মেয়ে। মাঝখানে ছেলে ও বাম পাশে ছোট মেয়ে। সবার গলায় আলাদা আলাদা ওড়না দিয়ে গিট দেওয়া ছিল। অন্য কক্ষে ছিল মায়ের ঝুলন্ত লাশ।’
বাসার ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া মো. শরিফ খান লিটন জানান, ‘মোস্তফা কামালের চিৎকার শুনে আমি দৌড়ে এসে দেখি,তিন শিশুর লাশ পড়ে আছে। মা অন্য রুমে ঝুলে আছে।’
সংসারে কোনও পারিবারিক কলহ ছিল কিনা এমন প্রশ্নে প্রতিবেশী বাড়িওয়ালা শেখ শাহজাহান বলেন, ‘ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও ঝামেলা আমি কখনও দেখিনি। কামালের স্ত্রী আমাকে শ্রদ্ধা করতেন। আশা-যাওয়ার পথে দেখা হতো। কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তা কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি।’
এদিকে মোস্তফা কামালের বড় মেয়ে এন এম আখি শান্তার বান্ধবী গত পাঁচ দিন আগে বাসায় আসে। তখন শান্তার মা রেহানা পারভীন কথায় কথায় নাসরিনকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি (রেহানা), শান্তা, আরিশা, সাদ যদি মারা যাই তাহলে কি কষ্ট পাবা?’ নাসরিন বলে, ‘আমি তখন কিছু বলিনি। আমি ভাবছিলাম এমনিতেই বলছেন।’
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘তিন সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। আর রেহানা পারভীনের মৃত্যুর কারণ হত্যা না আত্মহত্যা তা এখনই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ জন্য তার দেহ থেকে নেক টিসু সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরিক্ষার জন্য পাঠিয়েছি।’
হত্যাকাণ্ড না আত্মহত্যা
তিন শিশু সন্তান ও মা নিহতের ঘটনা আত্মহত্যা না হত্যাকাণ্ড এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে তিন শিশুকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করলেও নিহত রেহানার স্বামী ও রেহানার বাবার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করছেন, রেহানা ও তার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে।
নিহতের স্বামী মোস্তফা কামালের অভিযোগ করেন, তার স্ত্রী ও সন্তানদের এলাকার দুই প্রভাবশালী মিলে হত্যা করেছেন। আর নিহতের অন্য স্বজনদের দাবি, পারিবারিক বিরোধের জেরে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। এলাকার দুই মসজিদের দুই সভাপতির ছেলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের কাছে আমার ৫০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এই টাকা ওরা অনেকদিন ধরে দিচ্ছে না। ওরা এতটাই প্রভাবশালী যে নাম বললে ওরা আমাকেও মেরে ফেলবে।’
নিহত রেহানা পারভিনের ভাই মাহবুব আলম সাগর বলেন, ‘পারিবারিক বিরোধের জের ধরে রেহানা পারভীনকে হত্যা করা হয়েছে। রেহানা পারভীনের সঙ্গে তার ননদ, দেবর ও শাশুড়ির বিরোধ চলে আসছিল। তারা গত দেড় বছর যাবত তুরাগের ওই বাড়ির ভাড়া তুলে সব টাকা নিয়ে যেত। তাদের (রেহানাদের) এক টাকাও দিতো না। মোস্তফা কামাল দীর্ঘদিন যাবত বেকার। কোনও ইনকাম না থাকায় তাদের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে ১৭ লাখ টাকায় পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করা হলেও তার একটি টাকাও তাদেরকে দেওয়া হয়নি।’
এদিকে নিহতের ভাবি সুলতানা বেগমে বলেন, ‘আমার ননদ (রেহানা পারভীন) সন্তাদের হত্যার পর আত্মহত্যা করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। রেহানা পারভীন উত্তরার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজ কল্যাণে মাস্টার্স পাস করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন না।’
সুলতানা বেগম আরও জানান, যে কক্ষে রেহানা পারভীন আত্মহত্যা করেছেন বলা হচ্ছে, সেই কক্ষের খাটের ওপর রেহানা পারভীন দাড়ালে ফ্যানে তার মাথা লেগে যায়। সেই ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করতে পারেন- এটা তা অবিশ্বাস্য। এটি সম্পূর্ণ সাজানো ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
আত্মহত্যা না হত্যাকাণ্ড এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ডিএমপি উত্তরা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার বিধান ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছি। হত্যাকাণ্ড না আত্মহত্যা তা তদন্ত শেষে বলা যাবে।’ এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মিজানুর রহমান।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস