কাজী সোহাগ, সাভার থেকে : গুরুত্বপূর্ণ সাভার এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৯ নির্বাচনী আসন। এ আসনে একটু আগেই বইছে নির্বাচনী উত্তাপ। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে চলছে মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা আছে বিএনপিতেও। তা অনেকটা গোপনে।
এতে নির্বাচনের অনেক আগেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা কৌশলে প্রচারণা চালাচ্ছেন নিজেদের পক্ষে। কর্মী-সমর্থকদের প্রস্তুত করছেন নির্বাচনের জন্য। শিল্প কারখানা ও শ্রমিক অধ্যুষিত সাভার এলাকায় রয়েছে নানা সমস্যা। বর্তমান সংসদ সদস্য দাবি করেছেন বিগত সময়ে এলাকার অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। তবে বিরোধীরা বলছেন, সমস্যা আগের মতোই আছে।
গত নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান নির্বাচিত হন। রানা প্লাজা ধসের পর তার মালিকানার এনাম মেডিকেল কলেজ দুর্ঘটনায় আহতদের সেবা ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আলোচনায় আসে। ডা. এনাম নিজেও পরিচিতি পান দেশজুড়ে। এ পরিচিতি আর জনপ্রিয়তার সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগের মনোয়ন পান সেখানকার আরেক পরিচিত মুখ মুরাদ জংকে হারিয়ে।
একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসন ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব নিকাশ। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একটু ভিন্নভাবে তাদের প্রচারণা চালাচ্ছেন। সাভার বাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অলিগলিতে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। সঙ্গে আছে বিলবোর্ড ও ব্যানার। নিজেদের ছবি দিয়ে তারা ভোট প্রার্থনা করছেন নৌকার পক্ষে, আওয়ামী লীগের পক্ষে।
একই ধারায় প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপিও। তারা ধানের শীষ প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের পোস্টারের ভিড়ে বিএনপির পোস্টার ও ব্যানার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রকাশ্যে না গোপনে এসব পোস্টার ও ব্যানার টানাতে হয়েছে বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাদের পোস্টার ও ব্যানার দেখলে ছিঁড়ে ফেলে।
তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের দাবি সাভারের আওয়ামী লীগ পোস্টার বা ব্যানার নির্ভর দল নয়। এখানে তারা জনপ্রিয় দল। বিএনপির সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। তাই তারা ব্যানার বা পোস্টার নির্ভর দল হিসেবে পরিণত হয়েছে। এদিকে দুই বড় দলের জোটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের রাজনৈতিক কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে। যদিও জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন নিতে চান আবুল কালাম আজাদ। তিনি সাভার উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি।
মনোনয়ন পেতে নানা কৌশল আওয়ামী লীগে : আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে এখন থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সাভার-১৯ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তিনটি গ্রুপে বিভক্ত এখানকার আওয়ামী লীগ। একটি গ্রুপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান এমপি ডা. এনামুর রহমান। অপর দুটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সাবেক এমপি মুরাদ জং ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হাসান তুহিন।
তবে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন এনামুর রহমান ও মুরাদ জং। তাদের কারণে বিভক্ত স্থানীয় আওয়াম লীগও। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই বর্তমান এমপির পক্ষের গ্রুপে রয়েছেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা। অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার রয়েছেন মুরাদ জংয়ের পক্ষে। এদিকে নির্বাচনী এলাকায় এই দুই নেতাই রটিয়েছেন আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
দলীয় প্রধানের কাছ থেকেও সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে তাদের। এ প্রসঙ্গে ডা. এনামুর রহমান বলেন, ২৫শে এপ্রিল আমাকে ঢাকায় ধানমন্ডির কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন। সেখানে আমাকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর আদেশে আদিষ্ট হয়ে আপনাকে বলা হচ্ছে যে আগামী নির্বাচনের জন্য কাজ করতে হবে। এই মেসেজটি পাওয়ার পরই আমি নির্বাচনী এলাকায় দলকে সংগঠিত করতে যা যা করা দরকার করে চলেছি।
নির্বাচনী এলাকায় একই দাবি করছেন সাবেক এমপি মুরাদ জং। তার অনুসারীরা জানান, এরই মধ্যে মুরাদ জং আগামী নির্বাচনের জন্য দল থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন। ওই নির্দেশ অনুযায়ী তিনি এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দল গোছাতে। মুরাদ জং বিদেশে অবস্থান করায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দারের সাভারের বাসায় গেলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
তিনি বিষয়টি নিয়ে মুরাদ জংয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ফারুক হাসান তুহিন জানান, দল থেকে আমাকে মনোনয়ন দিলে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলে একাধিক প্রার্থী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কাজ করবো না। মূল কথা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও নৌকার পক্ষে কাজ করবো।
গোপনে তৎপর বিএনপি : স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য, সাভারে বিএনপির যেকোনো পর্যায়ের নেতার নামে কমপক্ষে ১৫টি মামলা রয়েছে। বাড়িঘর দূরে থাক এলাকাতেও তারা থাকতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপরও আগামী নির্বাচনের জন্য নীরবে সংগঠিত হচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। রাতের অন্ধকারে তারা সাভারের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার ও ব্যানার লাগাচ্ছেন নেতাদের নামে। সাভারের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বিএনপির সাবেক এমপি ডা. দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন বাবু ও মেজর (অব.) মিজানুর রহমানের পোস্টার ও ব্যানার।
সাভারে নিজেদের অবস্থান প্রসঙ্গে সাভার থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, জনসমর্থনের দিক দিয়ে এখানে বিএনপির অবস্থান অনেক মজবুত। এই আসনে অতীতে সব সময় বিএনপি জয়লাভ করেছে। কিন্তু গত বিতর্কিত নির্বাচনে এখানকার আসন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন যদি ৬০ ভাগও সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তাহলে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ব্যবধান হবে এক থেকে দেড় লাখ ভোট। সুযোগ পেলে এখানকার জনগণ আওয়ামী লীগকে বুঝিয়ে দেবে। আসলে সবাই ভয়ে চুপ করে আছে।
তিনি বলেন, আমার নামে রয়েছে ১৫টি মামলা। সাংগঠনিক কোনো কাজ করতে দেয়া হয় না। পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয়া হয়। আসলে এখানে সংগঠন চালাচ্ছে পুলিশ। রাজনৈতিক নেতারা নয়। স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা জানান, অনেক দিন ধরেই সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচি নেই। বলতে গেলে এলাকা নেতাশূন্য। এখানে দল যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তার পক্ষেই কাজ করবে।
এদিকে বড় দুই দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের কোনো ধরনের সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বলে জানান স্থানীয় নেতারা। তবে আগামী নির্বাচনে এরই মধ্যে দলের সবুজ সংকেত পেয়েছেন বলে জানান উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, গত নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলাম। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন হওয়ায় শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়িয়েছি। যদি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
এদিকে জামায়াতের কোনো ধরনের তৎপরতা নেই বলে জানান স্থানীয় জনগণ। তারা বলেন, দলের কোনো নেতা-কর্মীকে গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। স্থানীয় জামায়াতের নেতাদের মোবাইলে ফোন করা হলে তাদের সবার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। দু’জনের বাড়িতে গেলে তারা ঢাকায় থাকেন বলে জানানো হয়।
৫ জনকে ক্রসফায়ার দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি: ডা. এনামুর রহমান
এদিকে সাভারের বর্তমান এমপি ডা. এনামুর রহমান নির্বাচনী এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মোবাইল ফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারও টুঁ শব্দ করার সাহস নেই।
এলাকায় চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানকার ব্যবসায়ীরা ডাকলেও কেউ চাঁদা নিতে আসেন না। কারণ তারা জানে, এমপি জানলে সমস্যা হবে। ঝুট ব্যবসা নিয়ে আগে কতকিছু হতো। এখন এসব নিয়ে টুঁ শব্দও নেই। প্রধানমন্ত্রী এসবের জন্য আমাকে ডেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
ডা. এনামুর রহমান বলেন, আমার মতো কোনো নেতা রাজনৈতিক তৎপরতা চালায়নি। সব সময় এলাকায় থাকি। মানুষের পাশে থাকি। দলের এমন অনেক কর্মসূচি ছিল যা কখনো পালন করা হয়নি। আমি এমপি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সব ধরনের কর্মসূচি পালন করেছি।
তিনি বলেন, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ না পেয়ে মুখরোচক বক্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাভারের এটা কালচার। যেই ভালো কাজ করবে তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি ছড়ানো হবে। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। এসব বিষয় নিয়ে আমি মোটেই চিন্তত নই। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি