নিউজ ডেস্ক : মায়ের মন খারাপ দেখলেই পাশে এসে বসে মুক্তামনি। বোঝার চেষ্টা করে মায়ের মেজাজ মর্জি। তারপর মাকে স্বাভাবিক দেখলে আরো কাছে গিয়ে নরম গলায় বলে, আমার কারণে তোমাদের অনেক চিন্তা হয় মা? চিন্তা করো না, আমি ভালো হয়ে যাবো।
নিজের মেয়ের মানসিক দৃঢ়তার বর্ণনা দিয়ে মুক্তামনির মা আসমা খাতুন হাসপাতালের কেবিনে বসে বলেন, মাঝে মধ্যে আমার যখন মেজাজ খারাপ হয়, তখন ও আমার কাছে আসে। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘আমার কারণে তোমাদের অনেক কষ্ট হয়, মা? চিন্তা কর না, আমার জন্য দোয়া করো দেখ আমি ভালো হয়ে যাবো।’
আজ শনিবার অপারেশনের আগের রাতেও মাকে ঘুম থেকে ডেকে তার সাথে কথা বলেছে মুক্তামনি।
রাতে ঘুম থেকে আমাকে ডেকে তুলে বলেছে, ‘মা শোন, আমার কিছুই হবে না। কার যেনো এটা হয়েছিলো, তারপরেও সে ভালো হয়ে গিয়েছিল। দেখ আমিও ভালো হয়ে যাবো।’
সময় লাগলেও মুক্তামনির যে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে আশার কথা শুনিয়েছেন ডাক্তাররাও।
অপারেশন শেষে বার্ন ইউনিউটের পরিচালক ডাক্তার আবুল কালাম এবং সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, আজকের অপারেশনের ফলে মুক্তামনির হাত বাঁচানো গেছে। তবে হাত সচল করতে আরো অন্তত ছয়টি অপারেশন করতে হবে। তবে আমাদের আশা ও ভালো হয়ে যাবে। তবে এজন্য অনেক দূর যেতে হবে।
নিজের মেয়ের আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে কখনও গলা ধরে আসছিল মা আসমা খাতুনের। আবার মুক্তামনির চঞ্চলতার কথা তুলতে গিয়ে হেসেও উঠছিলেন কখনও কখনও।
‘ও খুব চঞ্চল। খুব কথা বলে। কিন্তু কোনো কথা ভুল বলে না। আমাদের কথা বলায় ভুল হয় কিন্তু ওর কখনও ভুল হয় না। ও এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যে ওর হাত না দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে ওর এত বড় রোগ হয়েছে।’
মুক্তামনি শুধু চঞ্চলই নয়, বুদ্ধিমতী এবং সৃষ্টিশীলও। মায়ের সাথে কারও ঝগড়া হলে সে মধ্যস্থতা করে, বাম হাত দিয়ে সে ছবিও আঁকতে পারে।
আসমা খাতুন বলেন, ও খুব ভালো ম্যানেজ করতে পারে। ধরেন আমার সাথে কারো ঝগড়া হলো। ও আমার অগোচরে তাদের বলে, দেখেন আমার এতবড় রোগের কারণে মায়ের মন হয়তো খুব খারাপ থাকে। তাই হয়তো আপনাদের সাথে ঝগড়া হয়েছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না।
আসমা বলেন, হাসপাতালে এসেও সে বাবাকে বলেছে, আমাকে একটা খাতা এনে দাও আমি ছবি আঁকবো।
‘ও আমাদের সবার ছবি আঁকে। সবাই সে ছবিতে হাসিখুশী থাকে, শুধু ওর চোখে পানি এঁকে দেয়। ওর বাবা জিজ্ঞেস করে, তোমার চোখে পানি কেন মা? ও বলে আমার অনেক কষ্ট তো তাই।’
শিশু শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে ওঠার পর রোগ ধরা পড়ে মুক্তামনির। এরপর থেকে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। একই সাথে স্কুলে ভর্তি হওয়া জমজ বোন হীরামনি এবার ক্লাস ফোরে পড়ে।
হীরামনির আশা, তার বোন আবার সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আবার দুই বোন একসাথে যেতে পারবে স্কুলে।
মুদি দোকানী বাবা ইব্রাহিম মিয়ার আশা, সারা দেশের এত মানুষ যখন দোয়া করছে তখন মুক্তামনি ভালো না হয়ে পারে না।
ভালো হওয়ার আশা ছেড়ে দিলেও অস্ত্রোপচারের পর নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন মা আসমা খাতুন।
শনিবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। এর আগে সকাল পৌনে আটটায় মুক্তমনিকে ওটিতে নেয়া হয়।
চার সদস্যের অ্যানাসথেসিয়া চিকিৎসকসহ ১৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অস্ত্রোপচারে অংশ নেন।
সাতক্ষীরার মেয়ে মুক্তামনির দেহে জন্মের দেড় বছর পর একটি ছোট মার্বেলের মতো গোটা দেখা দেয়। এরপর সেটি গাছের গুড়ির রূপ নিয়ে বড় হতে হতে ডান হাত শরীরের চেয়ে ভারী হয়ে উঠেছে। তার এ বিরল রোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়া হয়।
১১ জুলাই সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তামণির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। ১২ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে লিমফেটিক ম্যালফরমেশন রোগে ভুগছে মুক্তামনি। এটি একটি জন্মগত রোগ।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস