বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭, ০১:২৪:৩৮

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় হেভিওয়েট প্রার্থীদের লড়াই

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় হেভিওয়েট প্রার্থীদের লড়াই

ঢাকা : অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতেও বইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। এ এলাকায় প্রধান দলগুলোর যেমন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন তেমনই বিএনএফের প্রধান এস এম আবুল কালাম আজাদের মতো এমপিও নির্বাচিত হয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ ওয়ার্ড এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা নিয়ে গঠিত এ আসনটি। সংসদীয় তালিকায় এ এলাকাটি রয়েছে ১৯০ নম্বরে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘একক প্রার্থী’ হিসেবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির জাতীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওয়াকিল উদ্দিন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ এ আসনটি এবার মহাজোট বা অন্য কোনো দলকে ছাড় দিতে নারাজ। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও এ আসন থেকে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া তিনি। বিএনপি থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীও নির্বাচনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি।

বাংলাদেশ জাতীয় জোট—বিএনএ থেকে নির্বাচন করতে চান সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। এ ছাড়া এ আসনে বিএনএফ থেকে লড়বেন বর্তমান এমপি আবুল কালাম আজাদও। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। ঈদুল আজহা সামনে রেখে শুভেচ্ছাবার্তা দিয়ে প্রার্থীরা জানান দিচ্ছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের খুব একটা বাকি নেই।

অন্য দলকে ছাড় দিতে নারাজ স্থানীয় আওয়ামী লীগ : ঢাকা-১৭ আসনে এবার নৌকার নিজস্ব প্রার্থী চায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ। গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দলীয় এমপি না থাকায় ‘স্থানীয় নেতারা যেন বিরোধী দলে’। ‘জোটে ও ভোটে’ ছাড় দিয়ে বানানো এমপিদের সহায়তা পাচ্ছেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সে কারণে এবার নিজ দলের লোক দিয়ে নির্বাচন করানোর জোর দাবি উঠেছে।

এ আসনে নৌকা নিয়ে এবার নির্বাচন করতে চান আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওয়াকিল উদ্দিন। তিনি এ নির্বাচনী এলাকায় জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের সাড়াও পাচ্ছেন ব্যাপক।

গুলশান, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট ও ভাসানটেকের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনের যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শোকের ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার চোখে পড়ে। অধিকাংশ ব্যানার-ফেস্টুনের নিচে ‘সৌজন্য’ লেখা রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওয়াকিল উদ্দিনের নাম। তবে এসব পোস্টারে তার নিজস্ব কোনো ছবি নেই। দলীয় নির্দেশনায় তিনি শোকের মাসে নিজের ছবি ব্যবহার করেননি বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী মো. ওয়াকিল উদ্দিন বলেন, ‘জাতির জনকের নির্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছি। ১৯৭২ সালে গুলশান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। এরপর যুবলীগ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও এ আসনের এমপি ভিন্ন দলের। ফলে তখন থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ অঙ্গদলের সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছি এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ, প্রতিটি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আস্থার ও আত্মার।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছি। ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান, পরবর্তীতে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হিসেবে এ এলাকার প্রতিটি পাড়া-মহল্লার অবকাঠামো, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদসহ গরিব-দুঃখীদের সহযোগিতা করে এসেছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রত্যাশা করি, দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন এবার পাব। ’

আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে নৌকা নিয়ে নিজস্ব লোক লড়বে জানিয়ে দলের জাতীয় কমিটির সদস্য মো. ওয়াকিল উদ্দিন আরও বলেন, ‘দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর দাবি নিজস্ব লোক যেন নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে। আমার বিশ্বাস, আমার রাজনৈতিক অবদান, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের চাওয়া এবং মাঠের জরিপ মিলিয়ে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকেই নৌকা দেবেন। নেত্রীর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তবে কোনো কারণে যদি আমাকে মনোনয়ন না দেওয়া হয়, তাহলে নেত্রী যে নির্দেশনা দেবেন তা মেনে চলব। ’

এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ‘১৯৯৬, ২০০১ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলাম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনএফ প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের পক্ষে ভোট করতে নেত্রীর নির্দেশেই আমরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি ও ভোট দিয়েছি। এবারও নেত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। ’

ভাসানটেক থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘দুই মেয়াদে দল ক্ষমতায় রয়েছে, অথচ এ আসনে নৌকার ভোট নিয়ে যারা এমপি হয়েছেন তারা আমাদের নাগালের বাইরে। এবার এ আসন থেকে দলের প্রার্থীকে নৌকা দেবেন দলীয় সভানেত্রীর কাছে এমন দাবি জানাই। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াকিল উদ্দিন আমাদের সুখে-দুঃখে রয়েছেন তাকেই চাই। ’

গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘কূটনৈতিক জোনের অবস্থান এ আসনে হওয়ায় কূটনীতিকদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার-প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে ঢাকা-১৭ আসনের এমপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু দেশ-বিদেশ তো দূরের কথা সরকারের উন্নয়নের প্রচারণা চালিয়ে গুলশানেই একটি ফেস্টুন ওঠেনি তার নামে। ভিন্ন দলের হওয়ায় আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি-কর্মকাণ্ডে স্থানীয় এমপিকে পাওয়া যায় না। আগামীতে এ আসনে নৌকার নিজস্ব লোক চাই।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগের উত্তরের সহসভাপতি জাকির হোসেন বাবুল বলেন, ‘দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। অথচ এ এলাকার কর্মীরা যেন বিরোধী দলে। কারণ, তারা স্থানীয় এমপিকে কোনো কাজেই পান না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী চাই। এ আসনে দলীয় নেতা-কর্মীরা যে কোনো প্রয়োজনে ওয়াকিল উদ্দিনকে কাছে পান।’

সেনানিবাস আসনটি ছাড়বেন না এরশাদ : এ আসনে নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এ আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন তিনি। তখন এরশাদ রংপুর সদর ও কুড়িগ্রামের একটি আসন থেকেও জিতেছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা-১৭ রেখে বাকি দুটি ছেড়ে দেন। জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে এরশাদ ঢাকা সেনানিবাস, বনানী ও গুলশানের একাংশ নিয়ে গঠিত আসনটিতে নির্বাচন করবেন বলে মনস্থির করেছেন। এটা অনেকটাই নিশ্চিত। তিনি সেভাবে প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও এরশাদ ঢাকা-১৭, রংপুর-৩ ও লালমনিরহাট-১ আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। তখন নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে জাতীয় পার্টির নাটকীয়তার মধ্যে এরশাদ তিনটি আসন থেকেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। ঢাকা-১৭ আসনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহূত হলেও অন্য দুটিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন না করায় প্রার্থিতা রয়ে যায়।

আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি : ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। তার মৃত্যুতে এ আসনটিতে বিএনপি প্রার্থীশূন্যতায় পড়ে। ফলে এ আসন থেকে দলের পক্ষে মনোনয়ন পেতে কাজ করছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী।

জানা যায়, ‘বিএনপির হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়েই মাঠে তৎপর তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকেও সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে মনোনয়নের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যেও তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিএনপির ক্লিন ইমেজের এই নেতা ঢাকা-১৭ আসনে এরই মধ্যে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছেন। রাজনৈতিক মামলায় জেলও খাটেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে মাঠে রয়েছে। এ দাবি আদায় করেই আমরা নির্বাচনে যাব। এ আসনে দল থেকে আমাকে কাজ করতে বলা হয়েছে। আমি নিয়মিত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছি।’ তবে এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা প্রিন্সিপাল লিয়াকত আলীও। তিনিও নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ১৭টি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। ২০১৫ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনকালে দীর্ঘদিন আমি কারাভোগ করেছি। আগামী নির্বাচনে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হবে, এ ক্ষেত্রে দল যাকে মনোনয়ন  দেবে, তার পক্ষেই কাজ করতে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ। ’

মনোনয়ন চাইবেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও : বাংলাদেশ জাতীয় জোট—বিএনএ থেকে এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। তিনিও এ এলাকায় নানা কর্মসূচি পালন করছেন। মনোনয়ন প্রসঙ্গে নাজমুল হুদা বলেন, ‘আগামীতে আমি এ আসনে প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার চাচা সালমান এফ রহমান এবার ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) থেকে প্রার্থী হবেন। তাকে আমি ওই আসনটি ছেড়ে দেব। ’

ছাড় দেবেন না আবুল কালাম আজাদ : ঢাকা-১৭ আসনের বর্তমান এমপি বিএনএফ চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ। এরই মধ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছেন। তার নামে শুভেচ্ছাবার্তাও শোভা পাচ্ছে অলিগলিতে। এ প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঢাকা-১৭ আসন থেকে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমি এ আসনে লড়ব। দলের পাশাপাশি অভিজাত এ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে।’ বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে