রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ০১:৩৪:১০

‘ভাই, আমরা অনেক গরিব, কষ্ট অইলেই কাম ছাইড়া যাওন যায় না’

 ‘ভাই, আমরা অনেক গরিব, কষ্ট অইলেই  কাম ছাইড়া যাওন যায় না’

প্রদীপ দাস   :  রাজধানীতে লেগুনার (হিউম্যান হলার) অধিকাংশ হেলপারই ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু। কোনো রকম নিরাপত্তা ছাড়াই তারা গাড়ির হেলপারি করে।

যে বয়সে খেলাধুলা, পড়াশোনায় মেতে থাকার কথা; সেই বয়সে দরিদ্রতার কারণে এসব অধিকাংশ শিশুই হেলপারির মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এই শিশুদের কাজ মানবাধিকারের লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আইন প্রয়োগ না করা ও তাদের সহায়তায় লেগুনা মালিকরা আইন লঙ্ঘন করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

রাজধানী ফার্মগেটের ২৭ ইন্দিরা রোডে ৮ নভেম্বর বুধবার কথা হয় একরকম পূর্ণভাবে কাজ করা অধিকার বঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে। এদেরই একজন ১৪ বছর বয়সী সাব্বির। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চাদরধান্দায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সে। অটোরিকশার গ্যারেজে কাজ করে তার বাবা মো. তাইজ্জত।

আর মা মোছা. খুকি অন্যের বাসায় কাজ করেন। নেত্রকোণায় থাকার সময় সাব্বির হেফজখানায় পড়াশোনা করলেও ঢাকায় আসার পর আর সুযোগ হয়নি। আব্বু-আম্মু কাজ করে, তারপর পড়াশোনা ছেড়ে উপার্জন করতে আসার কারণ জানতে চাইলে সাব্বির বলে, ‘ভাই, আমরা অনেক গরিব।’

সাব্বিরের দুইবোন পড়াশোন করছে, আরেকজন এখনো ছোটো। ভাইয়ের মধ্যে সাব্বির একাই। তাই বাবা-মার পাশাপাশি তাদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ জোগানো সাব্বিরের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। তাই দিন শেষে যা আয় হয় তার সবটাই রাতে বাসায় এসে সে তুলে দেয় বাবার হাতে। গড়ে প্রতিদিন তিনশ করে আয় করা সাব্বিরের বেতন তার বাবার চেয়ে বেশি। এ বিষয়ে সাব্বিরের বক্তব্য, ‘আমি তো গাড়িতে কাজ করি, সেজন্য আমার বেতন বেশি।’

২০১২ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসলে ছোটো হওয়ায় প্রথম এক বছর সাব্বির কোনো কাজ করতে পারত না। পরের বছর এক হোটেলে কাজ নিয়ে সেখানে দুই বছর কাজ করে সে। এরপর থেকে টানা দুই বছর ধরে লেগুনার হেলপারি করছে সাব্বির।

ভোর ৫টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১১টা, সাড়ে ১১টায় বাসায় ফেরে সাব্বির। প্রতিদিন এভাবে কাজ করা বিষয়ে সাব্বির বলে, ‘ভাই, আমরা অনেক গরিব, কষ্ট অইলেই তো আর কাম ছাইড়া যাওন যায় না। কষ্ট তো অইবই। গাড়ির সিরিয়াল পড়ে আমাদের কম কষ্ট। সিরিয়াল পড়লে ঘুমানি যায়, বইয়া জিরানি যায়। আর যুদি যাত্রী বেশি থাহে তাইলে কষ্ট।’
বাইরে আর খেলাধুলা সুযোগ হয় না। যখন লেগুনা চালাতে হয় না, তখন লেগুনাস্যান্ডেই পরিচিতদের সঙ্গে মজা করে সাব্বির। গাড়ির মালিক বা চালক কোথাও বেড়াতে গেলে কিংবা কোনো কারণে গাড়ি বন্ধ থাকলেই কেবল সাব্বিরের ছুটি মেলে।

প্রতিদিন এভাবে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করলেও সাব্বির তার প্রাপ্য পুরোটা পায় না। সাব্বির জানায়, প্রতিদিন তাদের লেগুনায় আয় হয় ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। জমা, গ্যাস, লাইনসহ আরো নানা জায়গায় টাকা দেওয়া শেষে যা অবশিষ্ট থাকে তা চালক ও হেলপার ভাগ করে নেন। কিন্তু সেই টাকা চালকদের ক্ষেত্রে গড়ে পাঁচশ এবং হেলপারদের ক্ষেত্রে তিনশ বেশি পড়ে না।

বাবা-মার সঙ্গে থাকলেও ভোর ৫টায় বাসা থেকে বের হয়ে আসায় সকালের খাবারও পরিবারের সবার সঙ্গে খেতে পারে না সাব্বির। কাজে আসার পর চালকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সকাল ও দুপুরের নাস্তা করে সে। রাতেই কেবল বাসায় খাওয়ার সুযোগ হয় তার।

দীর্ঘদিন ধরে এভাবে কাজ করায় স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে জানায় সাব্বির। সে বলে, ‘এহন কিছু খাইলেই গ্যাস অইয়া যায়।’ তবে সাব্বিরের সব স্বপ্নই এই লেগুনাকে ঘিরেই। সাব্বির বলে, ‘বড় অইয়া গাড়ি চালানো শিখমু, আর একটা লেগুনা কিনমু।’ সাব্বির এখন টুকটাক লেগুনা চালাতে পারলেও পুরোটা আয়ত্ত্ব করতে পারেনি। আয়ত্ত্ব করতে পারলেই তার ওস্তাদের মতো সেও একদিন চালক হয়ে যাবে। সাব্বির বলে, ‘গাড়ি তো আমাগো অইহনাই কেউ দিব না, আরেকটু লম্বা অইলে দিব।’

► রনির কোনো ‘কষ্ট নেই’ ।

বরিশাল থেকে অনেক আগেই বাবা-মার সঙ্গে রনির পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ঠিক কবে তারা ঢাকায় এসেছিল তা বলতে পারে না ১২ বছর বয়সী রনি। তবে যে বাবার সাহসে ভর করে রনির পরিবার ঢাকায় এসেছিল, সেই বাবা আর নেই। মুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ছয় মাসে আগে তিনি মারা যান। তবে বাবার এই ক্যান্সার মারা যাওয়ার তিন বছর আগেই জানতে পেরেছিল রনি ও তার পরিবার। তাই বাবার চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ যোগাতে রনিও রোজগার করতে লেগুনায় হেলপারি শুরু করে।

বাবাকে বাঁচাতে না পারলেও রনির টাকায় রাজধানীর আদাবর-১০-এ থাকা পরিবারের বাজার খরচ হয়। এখন রনির মা অন্যের বাসায় কাজ করে, ছোট এক বোন পড়াশোনা করে, অন্য বোন আত্মীয়ের বাসায় থাকে। রনির বড় অন্য তিন ভাই আলাদা থাকে।

সাব্বিরের মতো রনিও প্রতিদিন কাজে আসে। সে ভোর ৬টায় এসে রাতে বাসায় ফিরে। তবে রনি সকালের খাবার বাসা থেকেই খেয়ে আসে। নাস্তার টাকা খরচ না করে তা মায়ের হাতে তুলে দেয় সে। রনিও কোনো খেলাধুলা করে না। তার কাজ করতেই বেশি ভালো লাগে বলে সে জানায়।

কোন বিষয়টা বেশি কষ্ট দেয় জানতে চাইলে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ধীর গলায় রনি বলে, ‘কষ্ট লাগে না।’ তবে রাতে বাসায় যেয়ে মায়ের হাতে যখন টাকা দেয় তখনই রনির সব চেয়ে বেশি ভালো লাগে। রনির স্বপ্নও বড়ো হয়ে গাড়ি চালানো। সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাবে। মাকে ছেড়ে যাবে না, কাজও করতে দেবে না রনি। এখন সে হালকা গাড়ি চালাতে পারে। সেও জানায় আরেকটু লম্বা হলেই চালক হয়ে যাবে। রনি বলে, ‘মালিকরে ৫ হাজার টাকা দিয়া এক মাস গাড়ি চালামু।

 এক মাসে আমি যদি কোনো জায়গায় না লাগাইয়া দেই, তাইলেই মালিক আমারে গাড়ি আর টেকা দিয়া দিব। আর যদি গাড়ি লাগাইয়া দেই, অ্যাক্সিডেন্ট করি; তাইলে গাড়িও দিবো না, টেকাও দিবো না। ওই টাকা দিয়া মালিক গাড়ি ঠিক করব।’

‘আরেকটু লম্বা হলেও তো ১৮ বছর হবে না, তাহলে মালিক গাড়ি দিবে?’ এমন প্রশ্নের জাবাবে রনি বলে, ‘মালিক দিবো। সার্জেন্টরা ধরলে তিন-চার শ দেওয়া লাগে। টেহা দিলেই ছাইড়া দেয়।’ ‘১৮ বছরের নিচেও চালক হওয়া যায়’।

রাহাতের আম্মু অন্যের বাসায় কাজ করে, আব্বু পেঁয়াজু বিক্রি করে। রাজধানীর টিক্কাপাড়ায় থাকা রাহাত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও পরিবারের সাথে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসার পর আর হয়নি। দুই বছর আগে ঢাকায় আসা ১২ বছর বয়সী রাহাত এক বছর ধরে লেগুনার হেলপারি করে। এখন তার আর পড়াশোনা করতেই ইচ্ছে করে না।

এখন রাহাতের স্বপ্ন গাড়ি চালানো শেখা। ১৮ বছরের নিচে তো গাড়ির চালাক হওয়া যাবে না, এমন কথা বললে রাহাত বলে, ‘১৮ বছরের নিচেও (চালক) হওয়া যায়। রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাইতে পারলেই গাড়ি দিয়া দিব।’ রাহাত বলে, ‘মালিক সামনে বইব, আর আমারে কইব, তুই চালা আমি দেখমু। যদি আমার চালানি ভালো অয়, তাইলে আমারে গাড়ি দিয়া দিব।’

আইনি জটিলতার বিষয়ে রাহাত বলে, ‘বয়স-টয়স দেখে না। পুলিশে ঝামেলা করলে মালিক দেখব। মালিক কইব, দুই-একশ দিয়া দে। দিলেই অইয়া যাইব। আর প্রত্যেক দিন তো আর ধরে না, মাঝেমধ্যে ধরলে এইডা করা অয়।’গাড়ি চালাতে চালাতেই সবাই লেগুনার চালক হয় বলে জানায় অল্পবসয়ী হেলপাররা। --প্রিয়

এমটিনিউজ২৪/এম.জে/এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে