সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ০১:৫৬:২৯

প্রাচীন সব ঐতিহ্য হারাচ্ছে পুরান ঢাকা

প্রাচীন সব ঐতিহ্য হারাচ্ছে পুরান ঢাকা

মাহবুব মমতাজী : একসময় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুন্দর ও ছিমছাম একটি নগরী ছিল পুরান ঢাকা। কিন্তু মুঘল শাসকদের পতনের পর থেকে পুরান ঢাকায় বিপর্যয় নেমে আসে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

ব্রিটিশ শাসকরা এ শহরের কিছু দেখভাল করলেও বর্তমান সময়ের প্রশাসনযন্ত্রের অবহেলায় পুরান ঢাকা ধীরে ধীরে তার শ্রী, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। সংরক্ষণের অবহেলায় লালবাগ, সূত্রাপুর, চকবাজার ও কোতোয়ালি থানা এলাকার হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন সব ঐতিহ্য।

পুরান ঢাকায় প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে হোসনি দালান, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, নিকিসাহেবের বাড়ি, রূপলাল হাউস, চকবাজার শাহি মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, মীর ইয়াকুব ইমামবাড়ি, করতলব খান মসজিদ ও হাসিনা মঞ্জিলসহ শতাধিক ভবন।

২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে যে ৯৩টি ভবন ও চারটি এলাকাকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, সেসব স্থাপনাও বাদ যাচ্ছে না ধ্বংসের হাত থেকে—এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।

২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাজউকের এক গেজেটে বলা হয়, ‘নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত হেরিটেজ ভবন, স্থাপনা অপসারণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পুনর্নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।’

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য আইন, ২০০৪-এর খসড়ার ১৮ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো স্থাবর প্রত্নসম্পদের মালিক যে-ই হোক না কেন তা ধ্বংস, ভাঙা, বিনষ্ট, পরিবর্তন, ক্ষতিসাধন করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল-জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি দেওয়া যাবে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক বছরের পুরনো স্থাপনাকে হেরিটেজের তালিকায় রাখা হয়। ওই তালিকাভুক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা গড়তে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে হেরিটেজ তালিকায় থাকা এসব স্থাপনা ভাঙতে হলে রাজউকেরও বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন।

জানা গেছে, ঐতিহাসিক যে কোনো স্থাপনার আশপাশের ২৫০ মিটার এলাকাকে ‘বাফার জোন’ বলা হয়, যেখানে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ করা নিষিদ্ধ।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চকবাজারের ১ নম্বর চম্পাতলী লেনে ছোট কাটরা। এর কিছু অংশ দখল করেছেন স্থানীয় কিছু সাবান ও প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিকরা।

এর পাশের ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজার বাড়িটির পুরনো চিত্র বের করা প্রায় দুরূহ, যার দেয়াল ও ভবন দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এটি বংশগত সূত্রে ৬৪ জন ব্যক্তির নামে লিজ দেওয়া হলে পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের মালিক দাবি করে ভবনের সামনে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন।

এমনকি ডিআইটি ও রাজউকের মানচিত্র থেকেও ছোট কাটরা, বড় কাটরা ও ভাওয়াল জমিদার বাড়ি মুছে ফেলা হয়েছে। হাফিজুল্লাহ রোডের ‘দারোগা বাড়ি’ নামে পরিচিত শতবর্ষী ভবনটির প্রায় ৫০ শতাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে।

বিভিন্ন বহুতল ভবনের আধিক্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শন, যেগুলো খুঁজে বের করতে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন ঐতিহ্যপ্রেমীরা। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ ও দখল চলছে কয়েকশ বছরের পুরনো মুঘল স্থাপত্য ছোট কাটরার ভিতরে ও বাইরে। একই পরিস্থিতি বড় কাটরার ভিতরেও।

চারপাশে স্থানীয় এমপি হাজী সেলিম ও তেল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলীর মালিকানাধীন বহুতল কোল্ড স্টোরেজ এবং আবাসিক ভবনের কারণে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে নিদর্শন দুটি। এমনকি আবাসিক ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে সোয়ারী ঘাটে গড়ে ওঠা চরের মধ্যে।

১৪ নম্বর বেচারাম দেউরী পুরান ঘরটি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে বহু বছর ধরে। এর নিচের অংশে জুতার কারখানা বসানো হয়েছে। ১৬/২ বেচারাম লেনের আজগরী মঞ্জিলের অবস্থাও একই। ৩৪ ও ৬৭ বেগমবাজারের বাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যাবে শতাধিক বছরের পুরনো। এসব সংরক্ষণ ও সংস্কারে নেই কোনো ধরনের উদ্যোগ।

করুণ দশায় রয়েছে শাঁখারীবাজারের বাড়িগুলো, যেগুলো ঠিকমতো সংরক্ষণ করা হয় না এবং ভেঙে পুনর্নির্মাণও করা হয় না। আর শ্যামবাজার ও বুড়িগঙ্গার পাড়ে থাকা রূপলাল হাউসটি বানানো হয়েছে মরিচ-পিয়াজের আড়তখানা। লালবাগের আমলীগোলায় একাধিক ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট বানানো হয়েছে।

লালবাগ কেল্লার পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। কিন্তু আরমানিটোলায় ১৯ শতক জায়গায় নির্মিত আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত জমিদার নিকোলাস পোগজের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সংরক্ষিত ভবনের তালিকায় রাখা হয়নি, যেটি নিকি সাহেবের বাড়ি নামেও পরিচিত।

আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, পুরান ঢাকার হেরিটেজগুলোর অবস্থা এখন খুবই নাজুক। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৯ সালের তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ করতে ২০১২ সালে হাই কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে একটি হেরিটেজ কমিটি করা হয়। গত বছর আরও তিন হাজার ঐতিহ্যবাহী ভবনের একটি তালিকা ওই কমিটিকে দেওয়া হয়। চলতি বছর এসে জানা যায়, ওই কমিটি বাতিল করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।

রাজউকের ডেপুটি টাউন প্ল্যানার মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম জানান, হেরিটেজ যাতে নষ্ট না হয় এটি দেখভাল করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কিছু স্থানে হেরিটেজ ভবন ভাঙা হয়েছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভবন ভাঙা শুরু হয় সন্ধ্যায়।

সেটি বন্ধ করতে থানায় মামলা করতে পরদিন পর্যন্ত গড়ায়। ততক্ষণে ভবনের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়। এসবের জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে