রুদ্র মিজান ও শুভ্র দেব: বিটের তালে কেঁপে উঠছে ফ্লোর, চার দেয়াল। মঞ্চ থেকে আঙুলের জাদু দেখাচ্ছেন ডিজেরা। একের পর এক বাজছে হিন্দি, ইংরেজি গান। বিশাল বলরুমজুড়ে বর্ণিল আলো। লাল, নীল আলো-আবছা আঁধারে ওয়েস্টার্র্ন ড্যান্সে মেতে উঠেছেন তরুণ-তরুণীরা। অনেকের হাতে বিয়ারের ক্যান।
হুইস্কির গ্লাস। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে চিয়ারস করছিল তারা। নাচ করতে করতে বেসামাল হয়েছেন অনেকে। মিউজিকের তালে তালে অন্তরঙ্গভাবে মিশে যাচ্ছিলেন সমবেত নারী-পুরুষ। তরুণীদের লিপস্টিকের দাগ লেগেছিল অনেক তরুণের গালে, শার্টে, ব্লেজারে। ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ ফ্লোরের চার পাশের সোফায় বসেছিলেন সঙ্গীর কোলে-পাশে। রাতভর ছিলো আনন্দ-উন্মাদনা। এভাবেই চার দেয়ালের ভেতরে পালিত হয়েছে থার্টি ফার্স্ট নাইট। রাজধানীর তারকা হোটেলগুলো ঘুরে দেখা গেছে এসব দৃশ্য।
ফ্যাশন শো, লাতিন ড্যান্স চলছিলো সন্ধ্যা থেকেই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে রেডিসনের বলরুমের দৃশ্যপট। বিটের তালে চলছিলো ব্যালে ড্যান্স। স্বল্পবসনা তরুণীরা ঠাঁই নিয়েছেন নির্ধারিত পুরুষদের বুকে। নাচ করতে করতেই পান করছেন তারা। মদে-নাচে মাতাল হয়েছিলেন কেউ কেউ। মাথায় পানি ঢালতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। রাত ১টার পরে বাজাচ্ছিলেন ডিজে পরী। ড্যান্স ফ্লোরে কয়েক শ’ তরুণী। তিন-চার জনকে দেখা গেছে শাড়ি পরে এতে অংশ নিতে। শাড়িতেও ছিল চমক। হাত-পিঠকাটা ব্লাউজের সঙ্গে পাতলা শাড়ি পরেই সমান তালে নাচ করছিলেন সঙ্গীর সঙ্গে। তবে নাচতে নাচতে শাড়ি পরা তরুণীদের দুই-একজন অর্ধবসন হারা হয়েছেন। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী এই পার্টিতে ড্যান্স করছিলেন। তবে প্রফেশনাল তরুণীদের সংখ্যা ছিলো বেশি। মতিঝিল থেকে পার্টিতে অংশ নিয়েছিলেন রূপা নামের সাতাশ বছর বয়সী এক নারী।
তিনি জানান, তারকা হোটেলে ডাক পড়লেই ছুটে যান তিনি। পার্টিতে নাচ করেই সংসার চালান এক সন্তানের এই জননী। মতিঝিল থেকে রাত ৯টার দিকে পার্টিতে অংশ নেন তিনি। এক বন্ধুর দেয়া টিকিটে প্রবেশ করেন সেখানে। নেচে নেচে সারারাতে উপহার পেয়েছেন প্রায় আট হাজার টাকা। তবে, সুমি, লোনাসহ অনেক তরুণী জানান, পুরুষ সঙ্গীকে আনন্দ দিয়েও নগদ টাকা উপহার নেন তারা। কেউ কেউ নাচার পর কোনো উপহার না দিয়েই চলে যান। এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন ড্যান্স ফ্লোরের অনেক তরুণী। ‘বি’ গ্রেডের কয়েক মডেলকে দেখা গেছে সেখানে নাচ করে উপহার গ্রহণ করতে।
সুন্দরী তরুণীদের নিয়ে অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটেছে। মঞ্চে তখন হাতের যাদু দেখাচ্ছিলেন ডিজে মারিয়া। ফ্লোরে মাতাল নৃত্য। বলরুমের দরজার আশপাশে বিয়ারের ক্যান হাতে সমবেতরা। নাচ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সোফাতে বসে সঙ্গীকে জড়িয়ে বিটের তালে শরীর দুলানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। ওই সময়ে অন্য যুবকের হাত থেকে এক সন্দরী তরুণীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মাতাল যুবক। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা বেশিদূর যাওয়ার আগেই মাতাল যুবককে অন্যরা টেনে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরেই ওই যুবকের মাথায় পানি ঢেলে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন অন্যরা। কিছু সময় নাচার পরও সঙ্গী যুবকের কাছে একটা বিয়ারের আবদার করেছিলেন শারমিন নামের তরুণী। যুবক নগদ টাকা উপহার দিয়ে চলে যেতে চাইলেও কিছুতেই বিয়ার না পেয়ে ছাড়তে রাজি না তরুণী। তাকে টেনে হোটেলের স্টোর রুমে নিয়ে যাচ্ছিলেন শারমিন। রাত পৌনে ৪টার দিকে সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় রেডিসনের এই পার্টি।
তার আগে সন্ধ্যা থেকেই ওয়েস্টিন, রেডিসন ব্লু, ঢাকা রিজেন্সিসহ তারকা হোটেলগুলোতে ভিড় করছিলেন তরুণ-তরুণীরা। লাইন বেঁধে পার্টির ভেন্যুতে ঢুকেছেন তারা। রাত ১টার পর নিরাপত্তার কারণে ফটক বন্ধ করে দেয়া হয় রেডিসনের। নানা চেষ্টা তদবির করেও ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না। হোটেল কর্তৃপক্ষ ছাড়া কড়া পাহারায় ছিলো পুলিশ। ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের সদস্যরা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত হোটেলের আশপাশে অবস্থান নেন। কড়া নিরপত্তার কারণে অনুষ্ঠানে ঢুকতে না পেরে ফিরে গেছেন অনেকে। আয়োজকদের একজন সজল জানান, ছয়শ’ টিকিটের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার শ’ টিকেট বিক্রি হয়েছে তাদের। টিকেটের মূল্য ছিলো চার হাজার টাকা করে। কাপলের ক্ষেত্রে ছয় হাজার টাকা। পার্টিগুলোতে তেমন কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা না ঘটলেও পার্টি শেষে রেডিসনের ফটকের সামনে এক তরুণীকে নিজের গাড়িতে টেনে তুলতে গেলে ঘটে বিপত্তি। তরুণী যুবকের সঙ্গে যাবেন না। এই টানাটানির মধ্যেই তরুণীর পক্ষের যুবকদের সঙ্গে ওই যুবকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রাইভেট কারটি (ঢাকা মেট্টো-খ-২১৯১) টান দিয়ে দ্রুত ত্যাগ করতে চাইলে দুর্ঘটনার শিকার হন ড্যান্স ফ্লোরের এক তরুণী।
এছাড়াও ওয়েস্টিনের পার্টিতে দেশি-বিদেশি অনেকে অংশ নিয়েছিলেন। সঙ্গীকে নিয়েই রাতভর সেখানে আনন্দে মেতেছিলেন আগতরা। ঘড়ির কাঁটা ১২ ছুঁতেই ভিন্ন রকম এক বাদ্য বেজে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে নতুন বছরকে স্বাগত জানান সববেতরা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী, প্রেমিকাকে নিয়ে আসা অনেকেই ওয়েস্টিন থেকে ঘরে ফেরা শুরু করেন।
সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকা রিজেন্সিতে আনাগোনা বেড়ে যায় অভিজাত ঘরের তরুণ-তরুণীদের। ভিড় বাড়তে থাকে রিজেন্সির ১৪ তলায়। সেখানে হিন্দি, পপ ও ইংরেজি গানের তালে তালে ড্যান্সে মেতে উঠেছিলেন তারা। সঙ্গে বিয়ার, সিগারেট পান করছিলেন অবিরত। ঘড়ির কাঁটা কাউন্ট ডাউন শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে যায় উত্তেজনা। মাতাল উন্মাদনায় নেচে উঠেন তরুণ-তরুণীরা। তার সঙ্গে পারফর্ম করেন ডিজে সনিকা, ডিজে ডন, ডিজে ইয়ামিন, ডিজে সামান্তা, ডিজে রাজ্জি ও ডিজে রেইন। চলতে থাকে স্টমি স্কাই ড্যান্স গ্রুপের নন স্টপ মিউজিক সঙ্গে ছিল লেজার শো। সবকিছু মিলিয়ে রিজেন্সিতে চলছিল অন্যরকম উন্মাদনা।
থার্টিফার্স্টের এই রাতটি ছিল তাদের কাছে আনন্দঘন উন্মদনায় হারিয়ে যাওয়ার এক রাত। নাচতে নাচতে সঙ্গীকে একান্তে পেতে শুরু করে ভিন্ন চেষ্টা। অবশ্য যাদের আগে থেকে হোটেলে রুম বুকিং ছিল তাদের বেলায় কোন সমস্যা হয়নি। আবার অনেকেই প্রিয় মানুষটিকে একান্তে কাছে পাওয়ার জন্য হোটেল ত্যাগ করে চলে যান অন্যত্র। কেউ কেউ নিজের গাড়িতে করেই চলে যান লং ড্রাইভে। তবে যারা কোনো সঙ্গী ছাড়াই ডিজেতে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। টাকার বিনিময়ে খণ্ডকালীন সময়ে কিছু পেশাদার তরুণী তাদেরকে সঙ্গ দিয়েছেন। পেশাদার তরুণীরা অর্থের বিনিময়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গী হয়েছেন। এমনকি, নাচে সঙ্গী হওয়ার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাবি করেছেন তারা। কথা হয় জুঁই নামের এক তরুণীর সঙ্গে। তিনি চার বছর ধরে পার্টিতে কাজ করেন। বান্ধবীর হাত ধরেই প্রথম পার্টিতে আসা শুরু তার। প্রথমদিকে নাচ না জানার কারণে জমাতে পারেননি। ধীরে ধীরে এখন সবকিছু আয়ত্ত করেছেন। তিনি বলেন, পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে আমি এই কাজ করি। থার্টিফার্স্ট ছাড়া যে কোনো ধরনের পার্টিতে অংশগ্রহণ করি। নিজের প্রয়োজনেই সব ধরনের কাজ করি। তিনি জানান, তরুণরা নাচের সঙ্গীকে বিছানার সঙ্গী হিসাবে পেতে চায়। থার্টিফার্স্ট নাইটে চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের কাজই করি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী এবারের থার্টিফার্স্ট নাইট চার দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। থার্টিফার্স্ট নাইটকে সামনে রেখে অন্যান্য হোটেল রিসোর্টের পাশাপাশি রাজধানীর খিলক্ষেতের ঢাকা রিজেন্সির আয়োজনে কমতি ছিল না। ঢাকা রিজেন্সির এই পার্টিতে প্রবেশ মূল্য ছিল তিন হাজার টাকা। পার্টিতে বাইরে থেকে খাবার, সিগারেট, পানীয় নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এতে করে টিকেটের সঙ্গে থাকা নাস্তাও পানীয়র উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় অনেককে। প্রয়োজনে কোনো সিগারেট, খাবার পানি ও পানীয় ক্রয় করতে অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের বাইরে পুরো রাজধানীতে আতশবাজি উৎসবে পালিত হয়েছে বর্ষবরণ। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদেই ছিলো নানা আয়োজন।-এমজমিন
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি