শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ০৬:২৫:৫৮

যে কারণে খালেদা জিয়াকে নিয়ে অস্বস্তিতে কারাগারের আশপাশের লোকজন

 যে কারণে খালেদা জিয়াকে নিয়ে অস্বস্তিতে কারাগারের আশপাশের লোকজন

ঢাকা: নাজিম উদ্দীন রোড! ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি রোড। পুরান ঢাকার এই রোডেই ছিলো দুইশ বছরের পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। এই কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময় ও ক্ষমতার উত্থান-পতনে বহু বিখ্যাত-কুখ্যাত নেতার ঠায় হয়েছে এই কারাগারেই। জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বহু  ঘটনার সাক্ষী এই কারাগার। সেই কারাগারেই দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বন্দি আছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তার কারাবরণের ফলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে অস্বস্তিতে কারাগারের আশপাশের লোকজন।

২০১৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর করা হয় কেরাণীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে নির্মিত নতুন কারাগারে।  তখন থেকে এই কারাগারটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। তবে কয়েক মাস আগে এটিকে পরিণত করা হয় যাদুঘরে। টিকেট কেটে দর্শনার্থীরা এটি পরিদর্শনও করেছে। কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ধোয়া-মুছা করা হয় কারাগারটি।

৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার পর স্পষ্ট হয় কেন এই পুরনো কারাগারটি হঠাৎ ধোয়া-মুছা করা হয়েছে।  রায়ের দিন দুপুর পর্যন্তও কেউ ভাবেনি দেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ঠায় হবে এই গিঞ্জি-চিপাগলির পরিত্যক্ত কারাগারে!

রায় ঘোষণার পরপরই ৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া যায় পুরনো কারাগারের প্রশাসনিক ভবনে। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন আইজি প্রিজন।  সেখানেই রাখা হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে।

কারা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে পুরনো কারাগারের প্রশাসনিক ভবনে রাখা হয়েছে। তাই সেটিকে ‘সাবজেল’ বা ‘বিশেষ কারাগার’ যেটাই বলতে চান, তা বলা যাবে।

কারাগারে ভিআইপি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বিএনপি চেয়ারপার্সন।

খালেদা জিয়া এই কারাগারে থাকার কারণে নাজিম উদ্দীব রোড ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। প্রতিবেশীদের ঘরবাড়িতে প্রবেশে পড়তে হচ্ছে পুলিশি তল্লাশির মুখে। অনেকটা অঘোষিত ১৪৪ ধারার মতো অবস্থা পুরান ঢাকা জুড়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীরকে হঠাৎ প্রতিবেশী হিসেবে পেয়ে স্থানীয় লোকজন রয়েছেন সীমাহীন অস্বস্তিতে।

কারাগারের আশপাশের পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে কথা হয় এখানকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তাদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী কেউ বা শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজী নবী। খালেদা জিয়াকে আকস্মিক পরিত্যক্ত এই কারাগারে রাখায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন।

হাজী নবী বলেন, “খালেদা জিয়া কী অপরাধ করেছেন, তা আল্লাহ ভালো জানেন। তবে অপরাধ করলে যে কারোরই শাস্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি যিনিই হোন; অপরাধ করলে একদিন না একদিন এমন শাস্তির মুখোমুখি হতেই হয়। এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্যও শিক্ষা। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরাও একটি বার্তা পেলেন যে, দুর্নীতি করলে কারো ছাড় নেই। কারণ ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।”

তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের আগে থেকে এখানকার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি। এখানে যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি, তেমনি আবার দেখেছি স্বৈরশাসক এরশাদ, কুখ্যাত এরশাদ শিকদার কিংবা আরো বহু অপরাধীকে।  কত মানুষের ফাঁসি হবার আগেপরেে পরিস্থিতি দেখলাম! কিন্তু আগের সবকিছুর সাথে এসময়ের পার্থক্য আছে। খালেদা জিয়াকে এখানে পেয়ে ভালো লাগছে না আসলে। এটি আমরা প্রত্যাশা করিনি। এর জন্য  আমরা ঠিকভাবে রাস্তায় চলাচল করতে পারছি না। বাড়িতে ঢুকতে তল্লাশির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দোকান খুলতে পারছি না। লোকজন শংকিত। কী না কী হয়ে যায়!

নাজিম উদ্দীন রোডেই বাড়ি মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের। কারা ফটকের একেবারে মুখোমুখি কনফেকশনারীর দোকান তার। খালেদা জিয়ার এমন শাস্তির উচিত বলে মনে করেন না তিনি।

আব্দুল হাই বলেন, “এই বয়স্ক মহিলাকে আটকিয়ে লাভ কী? কয়দিন আর বাঁচবে? আজ বা কাল মারা যেতে পারে। আমরা তো তাকে টিভিতে দেখি ভালো করে কথা বলতে পারে না। হাঁটাচলা করতে পারে না। আসলে ওনার এখানে থাকাটা আমার ভালো লাগছে না। যে অর্থের জন্য ওনার জেল হয়েছে, শুনেছি ওই অর্থ উপহার হিসেবে আসছিলো। আমার মনে হয় তারেক রহমানের কারণে বিএনপির এই অবস্থা! আজকে খালেদা জিয়ার এই পরিণতির জন্য অনেকটা তারেক রহমান দায়ী। আর দেখুন ভাই, আমি পেটের দল করি। কোন দল আমাকে ভাত দিবে না। না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি। এখানে দোকানপাট করতে সমস্যা হচ্ছে! আবার একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এখানে দেখতেও খারাপ লাগছে! দোষ কম বেশি সবাই করে। তবে ওনাকে এভাবে না করলেও পারতো”

মো: মনোয়ার হোসেন, নাজিম উদ্দীন রোডে প্লাস্টিকের দোকানের মালিক। তিনি অবশ্য বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে দেখছেন।

তিনি বলেন, “আসলে এর মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতিতে আরেকটি নতুন ধারা শুরু হলো যে, প্রধানমন্ত্রীদেরও কারাগারে যেতে হয়। আইন সবার জন্য সমান-এর বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাই সামনে ক্ষমতার পালাবদলে কী হয়ে যায় বলা যায় না। কারণ দুর্নীতি কম বেশি সবাই করে। ক্ষমতাবানরা দুর্নীতি করে বেশি। খালেদা জিয়াও হয়তো ক্ষমতায় থাকাকালীন এমন কিছু ভুল করে বসেছিলেন যার শেষ পরিণতি হয়তো তিনি ক্ষমতায় থাকতে ভাবেননি।”

নাজিম উদ্দীন রোডের আরেকজন স্থায়ী বাসিন্দা শফিক আহমদ। বয়স ৭২ ছুঁই ছুঁই। জেলখানার পাশের মসজিদ ঘেঁষেই তার বাড়ি। বহুবছর ধরে ব্যবসায় করছেন এই রোডে। তিনি বলছিলেন, “মানুষ আতংকে দোকান খুলছে না । কখন কী হয় যায় তা নিয়ে শংকিত। আসলে সামনে নির্বাচন। এ সময় ওনাকে এখানে বন্দি রাখাটা দেশের জন্য ভালো কিছু হবে না।  এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয় তখন আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো। জেলখানা এমন একটি টাইটেল, তিনি ভেতরে যতোই সুখে, শান্তিতে থাকুন না কেন আমরা বুঝি যে তিনি জেলে বন্দি আছেন। একাত্তরের পর থেকে কত শত নেতাকর্মীদের এখানে আসতে যেতে দেখলাম। কিন্তু এবারের মতো সমস্যা মনে হচ্ছে না। এতো বছর এতো নেতা, আসামীকে আসতে দেখলাম, কিন্তু এখানে কোন মারামারি হয়নি। কিন্তু এখন ভয়ে আছি। কারণ, দেশে খালেদা জিয়ার সমর্থক আছে। তাদের নিয়ে আমরা বিচলিত।”

নাজিমউদ্দীন রোডেরই চায়ের দোকানদার, ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রফিক বলছিলেন, ওনার এটা প্রাপ্য না মনে হয় আমার কাছে। এরকম নাও করতে পারতো। মায়া সবার আছে। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে এখানে দেখে আমার ভালো লাগছে না। ওনাকে একটু ক্ষমা করে দেয়া উচিত ছিলো। আবার নির্বাচনের আগে এরকম না করলেও সমস্যা। একজন এগিয়ে যেতে অন্যজনকে ফাঁদে ফেলতে হয়; এই নিয়ম সবখানে আছে। আমাদের দেশে এটি বেশিই হয়!”

পাশে দাঁড়ানো ইয়াসমিন বেগম এর উল্টো উত্তর দিলেন। অনেকদিন এই কারাগার বন্ধ থাকায় এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে। এখন যদি খালেদা জিয়াকে দিয়ে আবারও এই কারাগার শুরু হয় তাহলে আমাদের ভালো হয়। এই নারী, পুরনো কারাগার পুনরায় চালু হোক; এমনটাই চাইছেন।

মাহবুব নামের একজন ছাত্র মজা করতেও ছাড়লেন না- ‘আসলে খালেদা জিয়ার মতো প্রতিবেশী পাওয়া সৌভাগ্যের। একদিন গর্ভ করে বলতে পারবো, “দেশের একজন সাবেক প্রধামন্ত্রী আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তবে কতোদিন তাকে এখানে পাবো সেটাই দেখার বিষয়”!

কারা ফটকে সাংবাদিকদের ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রায়হান। নাজিম উদ্দীন রোডেই তিনি বাসা ভাড়া করে থাকেন। তিনি বলছিলেন: “ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে এরশাদকে নাকি ৬ বছরের জেল দিয়েছিলেন। ৬ বছর জেল খেটে এরশাদ বের হওয়ার আগে কারাগারের ভেতরে নাকি একটি বরই গাছ লাগিয়ে বলেছিলেন, “একদিন এই গাছের বরই খাবেন খালেদা জিয়া। একটি সংবাদে দেখলাম সেটাই।  ২৮ বছর আগে কারাগারে থাকা অবস্থায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে বরই গাছ লাগিয়েছিলেন তাতে এখন বরই ধরেছে। এরশাদের দলের জনৈক এমপি নাকি সংসদ ভবনে প্রস্তাব করেছেন, কারাবিধান অনুযায়ী এ বরই খাওয়ার সুযোগ থেকে থাকলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে খেতে দেওয়া হোক।’

রায়হানের কথা শুনে মতামত ব্যক্ত করলেন তার সঙ্গে থাকা আরেকজন উৎসুক পথচারি ও পুরাতন ঢাকার বাসিন্দা রাসেদুল হক। তিনি একটি স্কুলে শিক্ষক। তিনি বলেন: ‘এ ঘটনা কতোটা সত্য বলতে পারবো না। তবে কারাগার এরিয়ার এক কোণায় একটি বরই গাছ ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। গাছটিতে প্রচুর বরই ধরেছে। ইচ্ছা করলে খাওয়ানো যায়। তবে এটি চরম সত্য যে, ইতিহাসের নিষ্ঠুর পৃষ্ঠা কখন কিভাবে কার নাম উঠে যায় তা বলা মুশকিল। ক্ষমতার পালাবদলে ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। অপরাধ থেকে কেউ রেহায় পায় না। আর তার মধ্যে কিছু অপরাধ সাজানো, কিছু অপরাধ নিজের হাতে নির্মিত। খালেদা জিয়ার দুর্নীতি কতোটা সত্য-মিথ্যা তা সময় বলে দিবে। তবে অতি ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিবাজ করে তোলে’-এই স্কুল শিক্ষকের দার্শনিক উক্তি!

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটি ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন দায়ের করে। ২০০৯ সালে মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এর মাঝে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদলতের নির্দেশে স্থগিত ছিল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ হলো এতিমদের জন্য সহায়তা হিসেবে আসা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ওই টাকা দিয়েছিল কুয়েতের আমির। সৌদি আরবের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যম ওই টাকা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। দুদকের অভিযোগ, ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামে তিনি একটা ট্রাস্ট গঠন করেন। তার ঠিকানা ছিল তার বাসভবন। ওই তহবিলের টাকা দুই ভাগ করে একভাগ তার দুই পূত্রকে সেটেলার ট্রাস্টি বানিয়ে সেখানে দেন। ৩২ জন সাক্ষী এই মামলায় সাক্ষ্য দেন বলে জানান দুদকের আইনজীবী।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নিয়ে বরাবরই বিএনপির পক্ষে বলা হয় রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা। বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারের ইন্দনে তড়িগড়ি করে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। আগামী রোববার কিংবা সোমবার আপিল করা হবে। দলটি আশা করছে, উচ্চতর আদালত ন্যায়বিচার করে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবেন।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে