ঢাকা: উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবির হত্যার একবছরের মাথায় ফের মাথাচারা দিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গত মঙ্গলবার (২০ মার্চ) ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে নাবিল মোবারক (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই কিশোরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয়নি হামলাকারী কিশোর।
মঙ্গলবার রাত ৯ টার দিকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের চার নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বর বাড়ির ছাদে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার একদিন পর নাবিল মোবারকের বাবা মকছুদ আলী উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নম্বর ৩৭।
মামলার এজাহারে মকছুদ আলী উল্লেখ করেন,‘মঙ্গলবার রাত ৮ টার দিকে নাবিলের মায়ের মোবাইলে জীবন ঢালী নামে একছেলে ফোন দিয়ে নাবিলকে খোঁজে। সে নিজেকে নাবিলের বন্ধু পরিচয় দেয়। এরপর নাবিল বাসা থেকে বের হয়ে যায়। রাত ৯ টার দিকে নাবিলের একজন শিক্ষক ফোন করে জানান, নাবিল মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এরপর সেখানে গিয়ে নাবিলকে তার মা ও ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। সেখান থেকে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।’
নাবিলকে হামলার আগে নিজের ফেসবুকে খুনের হুমকি দিয়ে স্ট্যাটাস দেয় জীবন ঢালী (সায়ান আহমেদ)।
শনিবার (২৪ মার্চ) বিকালে ঢামেক হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, নাবিলের থুতনি, গাল, গলা,তলপেট, হাত ও পিঠে অসংখ্য ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। বেডে শুয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছে। নাবিল উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে তৃতীয়।
ঘটনার বিষয়ে নাবিল জানায়, ‘‘জীবনের সঙ্গে কয়েক মাস ধরে আমার বন্ধুত্ব। সে আমার চেয়ে বয়সে বড়। তবে সে আমাকে খুব পছন্দ করতো। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের পার্কে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এরপর সে ফোন দিতো। মঙ্গলবার ফোন দিয়ে আমাকে তার বাসায় ডাকে। জীবনের বাবার একটি মোটরসাইকেল আছে, সেটি চালানোর জন্য আমাকে যেতে বলে। এরপর আমি যাই। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর সে আমাকে বলে,‘এখানে বাবা দেখে ফেলবে, আমাদের ছাদে চলো।’
এরপর আমি জীবনের সঙ্গে ওই বাসার ছাদে যাই। ছাদে কিছুক্ষণ থাকার পর সে আমাকে ছাদে রেখে ট্যাব আনার কথা বলে বাসায় যায়। বাসা থেকে আসার পর সে আমাকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। আমি এসময় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকলে জীবনের বড় ভাই এসে আমাকে উদ্ধার করেন। তিনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এসময় জীবনকে মাদকাসক্ত মনে হয়েছে। আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে আসার সময় জীবন তার বাসায় প্রবেশ করে। এসময় সে ‘খুন করে ফেলবো’ বলে আমাকে আবারও হুমকি দেয়।’’
তবে কী কারণে তার ওপরে হামলা করেছে জীবন ,সে বিষয়ে কিছু জানে না বলে জানায় নাবিল। সে বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি না কেন আমাকে সে হত্যা করতে চেয়েছিল।’
অভিযুক্ত জীবন ঢালী (১৭) উত্তরার একটি স্কুলের দশম শ্রেণির অনিয়মিত শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির নাগেরকান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম শাহিন মিয়া। ঘটনার দিন রাত ৮ টা ৩২ মিনিটে জীবন তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি দিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়। সেখানে সে ইংরেজি বর্ণে লেখে ‘সব শালারে খুন কইরা লামু’। এরপরই নাবিলকে তার বাসার ছাদে নিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সে।
ঘটনার পর থেকে জীবন পলাতক রয়েছে। পুলিশ একাধিকবার তার বাসাসহ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
উত্তরার স্থানীয় কিশোররা জানিয়েছে, জীবন ঢালী মাদক নেয়। সে স্থানীয় কিশোরদের একটি গ্রুপের সঙ্গেও জড়িত। নাবিল ও জীবনের মধ্যে একটি মোবাইল ফোন সেট নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ নিয়ে উত্তরার বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে কিশোরদের আলাপ করতে দেখা গেছে। মোবাইল ফোনের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে নাবিলের ভাই নাইফ আহমেদ বলেন, ‘নাবিলের কাছে টাকা চেয়েছিল জীবন। টাকা না দেওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে এখনও আমরা নিশ্চিত নই।’
নাবিলও কিছু পরিষ্কার করে বলছে না। ঘটনার পর নাবিলের পরিবারের একটি আইফোন পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে, উত্তরার কোনও গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে নাবিল। তাকে হত্যাচেষ্টার পর উত্তরার ‘ডিস্কো বয়েজ বাংলাদেশ’ গ্রুপ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যেখানেই জীবনকে পাওয়া যাবে, সেখানেই তাকে দাফন করার কথা বলা হয়েছে ওই গ্রুপে। নাবিলের পরিবারের কোনও সহযোগিতা লাগবে কিনা, তাও জানতে চেয়েছে ওই গ্রুপের সদস্যরা।
নাবিলের বাবা মকছুদ আলী বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের মাদবপুর উপজেলার আন্দীউড়া গ্রামে। আমি সৌদি আরবে থাকি। পরিবার নিয়ে সৌদি আরবে ছিলাম। তিন বছর আগে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য দেশে আসি। উত্তরায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় সেখানেই ফ্ল্যাট কিনে পরিবার রাখি। ছেলেমেয়ে সবাইকে স্কুলে ভর্তি করে দিই।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি হবিগঞ্জে ছিলাম। ফোনে খবর পেয়ে দ্রুত ঢাকায় চলে আসি। এসে দেখলাম এই অবস্থা।’
গত বছরের ৬ জানুয়ারি প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হামলায় মারা যায় আদনান কবির নামে একটি কিশোর। ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া কিশোররা স্বীকারোক্তি দেয়—আদনান হত্যাকাণ্ডের আগে উত্তরার গ্যাংগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ জানুয়ারি ডিস্কো বয়েজ গ্রুপ ও বিগবস গ্রুপের সদস্যরা নাইন স্টার গ্রুপের গ্যাং লিডার রাজুকে মারধর করে। দুদিন পর আজমপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচে নাইনস্টার গ্রুপের সদস্যরা বিগবস গ্রুপের গ্যাং লিডার ছোটনকে আক্রমণ করে। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়ির সামনে ডিস্কো বয়েজ গ্রুপ ও বিগবস গ্রুপের সদস্যরা নাইন স্টারের আদনান কবিরকে ধারালো অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে তার মৃত্যু হয়। আসামিদের দাবি, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নাইনস্টার গ্রুপের রাজু।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিরা জামিনে রয়েছে। নাবিলকে হত্যাচেষ্টার পর তারা আবারও একে-অপরকে দোষারোপ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। হুমকি দিচ্ছে।
নাবিল হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাবিল ও জীবন পূর্বপরিচত। তাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। কোনও একটি ঘটনা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে। এরই জেরে হয়তো এই ঘটনা ঘটেছে। তবে ভিকটিম নাবিল এখনও সুস্থ হয়নি। সে সুস্থ হলে এর রহস্য জানা যাবে।’
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস