ঢাকা : আমার মেয়েকে আমি বুকে নিতে চাইলাম, কেউ ধরতে দিলো না। মেয়েকে বুকে নিলে হয়তো সজাগ হতো। কিন্তু আমাকে বুকে নিতে দিলো না। আমি কখনও বুঝিনি বলাকা বাস আমার মেয়ের জীবনে কাল হবে।’
শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী ইসরাত জাহান রিপ্তি (১৫) সোমবার বাসচাপায় নিহত হয়। ঘটনার পর তার মা-বাবার কান্না থামছে না। মঙ্গলবার সকালে নিকুঞ্জ-২ এর ১/এ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় রিপ্তিদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে এভাবেই বিলাপ করে কান্না করতে দেখা গেছে। রিপ্তি যে স্কুলে পড়তো সেই একই স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের শিক্ষিকা তার মা খুরশীদা পারভীন লিপি।
মেয়ের ছবি নিয়ে মায়ের আহাজারিপ্রতিদিন স্কুল ছুটি হলে মায়ের সঙ্গেই বাসায় আসতো রিপ্তি। আগে ছুটি হলেও মায়ের জন্য প্রতিদিন বসে থাকতো সে। এরপর মা-মেয়ে মিলে বাসায় ফিরতেন। দুই মেয়ের মধ্যে বাবা-মায়ের আদরের ছোট মেয়ে রিপ্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ছবি নিয়ে তার বাবা-মাকে বিলাপ করতে দেখা গেছে।
খুরশীদা পারভীন লিপি মেয়েকে হারিয়ে নির্বাক প্রায়। কিছুক্ষণ পরপর তিনি রিপ্তি রিপ্তি করে কান্না করে উঠছেন। এসময় পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও সান্ত্বনাই এই মায়ের সীমাহীন যন্ত্রণা লাঘব করতে পারছে না। তিনি বিলাপ করে বলেন, ‘আমার সঙ্গেই মেয়ে দুপুরের ভাত খেলো। আমি বললাম, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস, ম্যাডাম পড়াবে না হয়তো।
মেয়ে বলল, পড়াবে, সবাই যাচ্ছে। এরপর আমার ভাই (রিপ্তির মামা) বাসায় এসে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায়। আমি নতুন একটা কটি কিনে দিয়েছি, সেটা পড়লো, নতুন কটি পড়ে খুব খুশি হলো। বাবাকে দেখায় আর জিজ্ঞাস করে, বাবা আমাকে কেমন লাগছে? ওর বাবা বলল, ‘খুব ভালো লাগছে।’
রিপ্তির বিছানায়, বই খাতা। তিনি বলেন, ‘সোমবার বিকাল পৌনে ৩টার সময় মামা খালিদ হোসেন লিটনের সঙ্গে মাটিকাটা এলাকায় প্রাইভেট পড়তে যায় রিপ্তি। ৪টা ২৫ মিনিটে রিপ্তি আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘মা আমি মামাকে পাচ্ছি না।’ তখন আমি তাকে বললাম, তোমার মামা যেখানে তোমাকে নামিয়ে দিয়েছে, সেখানেই সে আছে, তুমি হেঁটে একটু সামনে যাও।
এরপর তার মামাকে দেখে সে আমাকে বলল, ‘মা, আমি মামাকে দেখেছি।’ আমি তাকে বললাম, ‘তুমি সাবধানে এসো। মামাকে ভালো করে ধরে রেখো। কথা বলে সে মোটরসাইকেলে উঠলো।’ এর ৫ মিনিটের মাথায় আমার কাছে একটা ফোন আসে।
ফোন রিসিভ করার পর এক লোক বললেন, অ্যাক্সিডেন্ট। আমি বুঝতে পারিনি যে আমার মেয়ে। আমার মেয়ের জীবনের জন্য বলাকা বাস কাল হবে। আমি দ্রুত শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে যাই। গিয়ে দেখি আমার মেয়ে ফুটপাতে শোয়ানো, বালুর ওপর।’ এসময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তার পাশেই বসা ছিলেন রিপ্তির বাবা সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার জহিরুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি দুই মেয়েকে নিয়ে দুপুরে একসঙ্গে ভাত খেয়েছি। এরপর রিপ্তি ভাত খেয়ে প্রাইভেট পড়তে যায়, এরপর এই ঘটনা।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিপ্তির মা বলেন, ‘পথচারীরা সবাই দেখছে। তারা আমাকে বলছে, মোটরসাইকেল ঠিকভাবেই রাস্তা দিয়ে বাসার দিকে (খিলক্ষেত) আসছিল। শেওড়াবাস স্ট্যান্ড এলাকায় প্রথমে একটি বাস পেছন দিক থেকে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এরপর মোটরসাইকেল পড়ে যায়। অটোরিকশাও চলে যায়। পেছন দিক থেকে দ্রুতগতিতে থাকা একটা বলাকা বাস আমার মেয়ের ওপর উঠে যায়।
এরপর মোটরসাইকেল ও আমার ভাই বলাকা বাসের নিচে পড়ে যায়। বাসটি মোটরসাইকেলসহ আমার ভাইকে টানতে টানতে অনেক দূর নিয়ে যায়। এই ঘটনা একজন প্রাইভেটকার চালক দেখে বলাকা বাসটির সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দেন। তখন চালককে আটক করা হয়।
আমার ভাইকে বাসের নিচ থেকে টেনে বের করা হয়। আর মেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ভাইকে নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আমার মেয়ে সেখানেই পড়ে ছিল। আমি গিয়ে দেখি মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, তার ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা। আমি কাছে যেতে চাইলে কেউ আমাকে যেতে দেয়নি। দেখতে দেয়নি।’
বাস চালকদের দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েও সমালোচনা করেন রিপ্তির পরিবার। তাদের প্রশ্ন, যারা মানুষকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাদের কি কোনও মনুষত্ব আছে? তারা কীভাবে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পায়?
খিলক্ষেত থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাসটির চালক তাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছি। বাসটি জব্দ করেছি। চালককে কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে।’
রিপ্তিকে মানিকদি এলাকায় তার নানার কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে। তার মামা এখনও আশঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এমটিনিউজ২৪/এম.জে/এস