বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:৫৮:৪২

‘আব্বু, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও’

‘আব্বু, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও’

ঢাকা : ‘আব্বু, আমি জীবনযুদ্ধে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও।’ একথাগুলো এক সাইসাইড নোটে লিখেছিলেন এইচএসসি পরিক্ষার্থী শেফা আলম।

গত সোমবার (১৬ এপ্রিল) বিকালে পুলিশ উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাড়ির ট্রাস্ট কলেজের হোস্টেল থেকে শেফা আলমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময় একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার করা হয়, যা এখন আলামত হিসেবে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশের কাছে রয়েছে।

সুসাইডাল নোটটি শেফা আলমের সহপাঠী ও শিক্ষকরা পড়েছিলেন। তাদের একজন দীপ্ত সরকার। তিনিও এইচএসসি পরিক্ষার্থী। দীপ্ত সরকার  বলেন, ‘নীল কালিতে লেখা ওই সুইসাইড নোট বাবা, মা, বোন ও ভাইকে উদ্দেশ করে লিখেছিল শেফা।’

দীপ্ত সরকার জানান, সুইসাইড নোটে শেফা আলম লিখেছেন, ‘আব্বু, আমি জীবনযুদ্ধে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও। আমি তোমার কাছে প্রমিজ করছিলাম, এ-প্লাস পাবো, আমি পারিনি। আমাকে মাফ করে দিও।’

এরপর ভাইকে উদ্দেশ করে শেফা লিখেছেন, ‘ভাইয়া, আমি তোকে বাইকের চাবিটা একেবারে দিয়ে দিলাম।’ এ ছাড়া, মা ও বোনকে উদ্দেশ করেও কিছু কথা লিখেছেন শেফা। দীপ্ত সরকার বলেন, ‘আমার এটুকু মনে আছে। বাকি কথাগুলো মনে পড়ছে না।’

পাবনার সদর থানার বাধানগর এলাকার শাহ আলমের মেয়ে শেফা উত্তরা ট্রাস্ট কলেজ থেকে এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নেন। তার পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল নবাব হাবীবুল্লাহ কলেজ। গত সোমবার তার জীববিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তিনি হোস্টেলে ফিরে আসেন।

সোমবার পরীক্ষাকেন্দ্রে কর্তব্যরত শিক্ষকরা কড়া পাহারা দেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করেন বলে জানান হোস্টেল সুপার ভক্তি রানী। তবে তখন শেফা আলম অধ্যক্ষের কাছে যাননি। এরপর সবার সঙ্গে শেফাও দুপুরের খাবার খেয়ে পঞ্চম তলায় তার কক্ষে অন্য এক সহপাঠীর সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েন।

শেফার কক্ষে থাকতেন শসী নামের তার এক সহপাঠী। তিনি  বলেন, ‘আমি দেখলাম, শেফা তার বেডে শুয়ে পড়ছে। তখন শেফা আমাকে বলল, যা চেয়েছিলাম, তা হলো না। আমি তাকে বললাম, থাক, মন খারাপ করিস না। এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ওটা আমাদের ঘুমানোর টাইম। প্রতিদিন আমরা বিকালে ঘুমাই।’

তিনি বলেন, ‘আমি সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠি। আমরা ১১ জন মেয়ে নামাজ পড়ি। দুইটা বাথরুমে অজু করা যায় না। তাই আমরা রান্নাঘরের কল ছেড়েও অজু করি। রান্নাঘরে আবার দরজা আছে। একটা মেয়ে সেখানে অজু করতে যায়। দেখে, রান্নাঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো।

এরপর খোঁজ নিয়ে দেখি, শেফা তার কক্ষে নেই। তখন আমরা বুঝতে পারি, শেফা ওখানে (রান্নাঘরে) আছে। আমরা ডাকাডাকি করি। কিন্তু সে আসে না। এরপর মুনা নামের এক মেয়ে দৌড়ে হোস্টেল সুপারের কাছে যায়। তখন হোস্টেল সুপারও দৌড়ে আসেন। আমরা সবাই দরজা ধাক্কাতে থাকি।’

দরজা ভেঙে শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকে বলে জানান হোস্টেল সুপার ভক্তি রানী। তিনি বলেন, ‘যেহেতু বাড়ির মালিক পুলিশের কর্মকর্তা, সেজন্য আমি তাকেও ব্যাপারটা জানাই। কলেজের অধ্যক্ষকেও জানাই। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে জানালার গ্রিল থেকে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে হোস্টেলে আছে। হোস্টেলে থেকেই সে লেখাপড়া করে।’

হোস্টেলের পঞ্চম তলার ওই বাড়িটি একজন পুলিশ কর্মকর্তার। বাড়িটির তৃতীয় তলায় বাড়িওয়ালা এবং দ্বিতীয় তলায় ট্রাস্ট কলেজের একজন শিক্ষক থাকেন। দুই ইউনিটের বাড়িটির বাকি তলাগুলোতে ট্রাস্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হোস্টেল। ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি জানান, লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।

উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পঞ্চম তলার রান্নাঘর থেকে সোমবার সন্ধ্যার পর লাশটি উদ্ধার করি। ওই রান্নাঘরে কোনও রান্না হয় না। বাইরে থেকে রান্না করে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কেবল ছাত্রীরা অজু করে।’

তিনি বলেন, ‘মেয়েটির পরিবারের আশা ছিল, সে জিপিএ-৫ পাবে। হয়তো পরীক্ষাটা খারাপ হয়েছিল। তাই সে চিরকুট লিখেছে, ‘জিপিএ-৫ না পেলে পরপারে দেখা হবে।’

এই ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে জানিয়ে ওসি আরও জানান, মামলার আলামত হিসেবে একটি ওষুধ কোম্পানির প্যাডে লেখা শেফার সুসাইডাল নোট, ওড়না এবং মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা লাশের ময়নাতদন্ত শেষে তার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছি। তারা লাশ নিয়ে গেছেন।’

এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে