নিউজ ডেস্ক: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা নাগাদ রানা প্লাজার সামনে আসেন গার্মেন্ট শ্রমিক আয়েশা আক্তার।
তার আশঙ্কা ছিল, সেদিন অফিসে না গেলে মাস শেষে বেতন দেবে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। মাস শেষ হতে তখন মাত্র ছয় দিন বাকি।
মনের ভেতরে এক ধরনের উদ্বেগ আর ভয় নিয়েই তিনি রানা প্লাজার সামনে গিয়েছিলেন।
কারণ এর আগের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবনে ফাটল দেখেছিলেন অনেক শ্রমিক।
রানা প্লাজা ভবনের সপ্তম তলায় নিউ ওয়েভ স্টার লিমিটেড কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আয়েশা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘২৩ তারিখ আমাদের বলা হইছিল ৯ তলায় কারেন্টের কাজ করবে। সকালে ছুটি দিয়ে বলা হইছিল যে লাঞ্চের পর আসার জন্য। ২টার দিকে আইসা দেখি যে লোকজন সবাই নিচে দাঁড়ায়ে আছে। কেউ উপরে যায় না। কিন্তু বাইরে থেকে দেখা গেছে জানালার সাইড দিয়া ফাটা। সেদিন সবাইকে ছুটি দেয়া হয়েছিল। বিল্ডিংয়ে আর কেউ ঢুকেনি।’
২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজার সামনে এসে আয়েশা আক্তার দেখলেন, কেউ ভবনের ভেতরে যাচ্ছে, আবার অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘তখন মালিকরা আর বিল্ডিংয়ের মালিক রানা গালাগালি করতাছে লোকজনদের। অনেকদের মাইর-ধইর কইরা উঠাইছে। শেষ পর্যন্ত আমি উঠলাম।’
পাঁচ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা মনে করে এখনও চিৎকার করে কাঁদেন আয়েশা আক্তার।
সেদিন শ্রমিকরা চাপে পড়ে ভবনের ভেতরে ঢুকলেও তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না।
তখন কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে তাদের শাসিয়ে যান বলে অভিযোগ করেন আয়েশা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘এর পর গিয়ে বসলাম। আমি এক পিস কাজ করছি মাত্র। হঠাৎ করে এমন জোরে আওয়াজ হইল, পেছন দিকে ফিরে তাকানোর সময়টুকু ছিল না।’
সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় জেনারেটর চালু করা হয়।
জেনারেটর চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট আওয়াজ হয় বলে জানান আয়েশা আক্তার।
সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন না। আমি এমন জোরে দৌড় দিছি... আল্লাহ হায়াত রাখছে…।’
দৌড়াতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারান তিনি। জ্ঞান ফিরে আয়েশা আক্তার দেখেন, তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। তার বাম হাত এবং বাম পা আটকে যায় কংক্রিটের নিচে।
সে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চুল যে রকম বেণী করি, সেই রকম বাম হাত আর বাম পা পিইষা ছিল। তখন আমি বললাম, ভাইয়া আমারে বাঁচান, হাতটা ছুটায়া দেন। আমার মনে শক্তি আছে। আমি পারব। আমি ওইখান থেকে বের হতে পারব।’
আয়েশা আক্তার যেখানে আটকা পড়েছিলেন সেখানে কিছু ভাঙা লোহা ছিল। সেই লোহা দিয়ে তার আটকেপড়া সহকর্মীরা সারা দিন শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে কংক্রিটের স্লাব ভাঙতে থাকেন।
আশপাশে তারা উদ্ধারকর্মীদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু আটকেপড়াদের চিৎকার উদ্ধারকর্মীদের কানে পৌঁচ্ছিল না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমরা সবার কথা শুনতেছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনে না। আমরা যে চিৎকার করতেছি, বাঁচাও-বাঁচাও বলতেছি, কেউ শোনে না।’
আটকেপড়াদের আর্তনাদ একপর্যায়ে একজন উদ্ধারকারীর কানে পৌঁছায়। তারপর উদ্ধারকারীরা এসে ছাদ কেটে তাদের বের করে।
আয়েশা আক্তারের যখন জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের বিছানায়। সৌভাগ্যক্রমে তার আঘাত তেমন একটা গুরুতর ছিল না।
পরের দিন হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি দেন চিকিৎসকরা।
সেই থেকে আর কোনো কারখানায় কাজ করেন না তিনি। পাঁচ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
তৈরি পোশাক কারখানার প্রতি মারাত্মক ভীতি তৈরি হয়েছে আয়েশা আক্তারের।
তার বর্ণনায়- ‘আমি চাকরি-বাকরি করি না। আমার ভয় লাগে... পারি না।’- বিবিসি বাংলা
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস