বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮, ০২:২৫:৪৩

কাজে লাগছে না ৬৮ কোটি টাকায় কেনা ঢাকার বজ্রপাত মোকাবেলার মেশিন

কাজে লাগছে না ৬৮ কোটি টাকায় কেনা ঢাকার বজ্রপাত মোকাবেলার মেশিন

ঢাকা: বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবেলা ও প্রাণহানি রোধে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছিল লাইটিং ডিটেক্টর যন্ত্র। ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তরের আওতায় এই যন্ত্র বসানো হলেও তা কারিগরি দক্ষতার অভাবে কোনো কাজে লাগছে না। ফলে ঢাকায় বসানো মেশিনটি দিতে পারছে না তেমন কোনো বার্তা। 

যন্ত্রটি কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ কথা ছিল বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই এটি তথ্য দেবে, যা অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে বার্তা পৌঁছে দিবে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই যন্ত্রটি চালু করা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শুধু এটি পর্যবেক্ষণের মধ্যেই নিজেদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন।

বজ্রপাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুরাদ আহমেদ ফারুখ। 

তিনি বলেন, ‘ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তর যে লাইটিং ডিটেক্টর যন্ত্র বসিয়েছে তা কোনো কাজে আসবে না। কারণ এই যন্ত্র চালানোর জন্য যে কারিগরি জ্ঞান দরকার তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাডার থেকে এই সেন্সরে বজ্রপাতের ১৫-২০ মিনিট আগেই শুধু পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। 

কিন্তু বজ্রমেঘ বা বজ্রপাত তৈরি হয় যে মেঘ থেকে, তা খুবই অস্থিতিশীল। ফলে প্রকৃত তথ্য সব সময় জানা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (বিএমডি) এই পূর্বাভাস জানাতে যে ওয়েদার অ্যাপ তৈরি করেছে, তা শুধু অ্যানড্রয়েডে চালিত মোবাইল ফোনেই চলবে। সে ক্ষেত্রে গরিব মানুষ এই সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যন্ত্র সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের ২৫০ কিলোমিটার এলাকা লাইটিং সেন্সরের আওতায় আসবে। আগাম সংকেত জানা গেলে রাজধানী ঢাকার মানুষেরাও সচেতন হবে। 

কিন্তু এটি প্রকৃত অর্থে নগরবাসীর তেমন কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও আরো সাত অঞ্চলে এই লাইটেনিং সেন্সর বসানো হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর এত দিন ধরে রাডার বা স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রেডিও, টেলিভিশন বা ওয়েবসাইটে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিয়ে আসছে। তবে এই নতুন সেন্সরের মাধ্যমে বজ্রপাতের সুনির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব। 

আমাদের ক্ষেত্রে এটি বাস্তবসম্মত নয় বা উপকার বয়ে আনবে না মত দিয়ে অধ্যাপক মুরাদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কয়জনের হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন রয়েছে? এ বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান।’

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, ২০১০ সালে ৬৫৮টি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ২৯৫টিতে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১৫ সালে ২২৬ জন, ২০১৭ সালে ৩৯১ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৮৮ জন মারা যায়। 

এ ছাড়া এ বছরের মে মাসের প্রথম ১৮ দিনে মারা গেছে ৭৪ জন। বেসরকারি একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে শুধু বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গত আট বছরের শুধু মে মাসেই মারা গেছে আট শতাধিক মানুষ।

জানা গেছে, এই লাইটেনিং ডিটেক্টর সেন্সর থেকে তথ্য প্রথমে ডিভাইসে ইনপুট করে সেখান থেকে তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ পূর্বাভাস কেন্দ্রে স্থাপিত মনিটরে ডিসপ্লে করে। 

এই মনিটরে দেখানো হয়, এক ঘণ্টায় কোথায় বজ্রপাত হয়েছে, কী পরিমাণ বজ্রপাত মাটিতে হয়েছে বা মেঘের ঘর্ষণের পরিমাণ কত। লাইটেনিং ডিটেক্টর যন্ত্র ব্যবহারে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বসানো এই সেন্সর এখনো স্টাডির পর্যায়ে আছে। 

এই সেন্সর থেকে সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল যাবে নরওয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরে। সেখান থেকেই এ বিষয়ে কারিগরি ও পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন আবহাওয়াবিদরা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আশা করি আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম গড়ে উঠবে। আমরা এই যন্ত্রটির সদ্ব্যবহার করতে পারব।’

ঢাকার আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জানান, এসব সেন্সর থেকে আপাতত পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন তাঁরা। পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরই শুধু তা দিয়ে বজ্রপাতের বিষয়ে মানুষকে আগাম সতর্কতা জানানো সম্ভব।’ 

এই আবহাওয়াবিদ আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা এই লাইটেনিং ডিটেক্টিভ সেন্সর শুধু চালু বা বন্ধের বিষয়টিই বিশেষজ্ঞরা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। এর ব্যবহার বা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়টিতে আমরা আমাদের জানা জ্ঞানই কাজে লাগাচ্ছি।’
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে