নিউজ ডেস্ক: নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার শিফট ইনচার্জ জিনাত আক্তার ও শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বুধবার সচিবালয়ে তদন্ত কমিটির এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা তদন্তে ৩ ডিসেম্বর রাতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা প্রতিবেদন পেয়েছি। প্রতিবেদনটি আমরা পর্যালোচনা করেছি। বিস্তারিত প্রতিবেদনটি আমরা পরে দিতে পারব।’
গত ৩ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর শান্তিনগরের নিজ বাসায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারী।
অরিত্রির আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে তারা বাবা দিলীপ অধিকারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অরিত্রির স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। গত রোববার সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষা চলার সময় তার কাছে একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকে পাঠায়। সোমবার স্কুলে গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়, অরিত্রি মোবাইল ফোনে নকল করছিল, তাই তাকে বহিষ্কারের (টিসি দেয়ার) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার মেয়ের সামনে আমাকে অনেক অপমান করে। এ অপমান এবং পরীক্ষা আর দিতে না পারার মানসিক আঘাত সইতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।’
তদন্ত কমিটির সুপারিশ তুলে ধরে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘অরিত্রির বাবা-মা আবেদন নিয়ে আসলে প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শিফট ইনচার্জ (প্রভাতী শাখা) জিনাত আক্তার, শ্রেণি শিক্ষক- ওই তিনজন ভয়ভীতি দেখান। অরিত্রির পিতা-মাতার সঙ্গে অধ্যক্ষ ও শিফট ইনচার্জ নির্মম ও নির্দয় আচরণ করেন। যা অরিত্রিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অরিত্রি পিতা-মাতার প্রতি অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে; তদন্ত কমিটির কাছে এমনটি প্রতীয়মান হয়েছে। যার দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানে প্রধান, শিফট ইনচার্জ ও শ্রেণি শিক্ষিকা এড়াতে পারেন না।’
‘সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে অরিত্রির আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে অভিযোগ এনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে’- বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই তিনজনকে আমরা বরখাস্তের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গভর্নিং বডিকে নির্দেশ দিচ্ছি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ ও বরখাস্তের কাজটি করে গভর্নিং বডি, আমরা সরাসরি করতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে বিভাগীয় মামলাসহ অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।’
‘এছাড়া ওই তিন শিক্ষকের এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ইতোমধ্যে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করা হয়েছে।’
গভর্নিং বডি ওই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে- একজন সাংবাদিক দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের কারণে আমরা সবকিছু এর মধ্যে নিয়ে আসতে পারব। আমরা তিনজনকে বরখাস্তের অর্ডার দিলাম, তা না করলে আমরা কমিটি ভেঙে দিতে পারি। সেই ক্ষমতা আমাদের আছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে পুলিশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, তারাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করছি তারাও ব্যবস্থা নেবে। আমরা প্ররোচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছি। পুলিশও হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না। ম্যানেজিং কমিটি যদি হাতগুটিয়ে বসে থাকে, তারাও এর মধ্যে পড়ে যাবে। তারা যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, বোঝা যাবে তাদেরও প্ররোচনা আছে এর মধ্যে।’
তদন্ত প্রতিবেদনে তিন দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি উঠে এসেছে- জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের অভিযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতির পর আমি অনেক টেলিফোন পাচ্ছি, অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘তারা আগে বলেননি, অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তিও আছেন। তারা বলেন, সাহস পাইনি, কারণ বললে আমার মেয়েকে তারা সমস্যায় ফেলতে পারেন। এটা ছেলে-মেয়েদের প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার মতো, অতীতে যা কখনও হয়নি।’
‘একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি বলেছেন, আমি আমার নাতিকে নিয়ে অপদস্থ হয়েছিলাম ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি বলেছি, তথন কেন বললেন না?’
ভিকারুননিসার বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘বহুদিন ধরে ওখানে অধ্যক্ষ নেই। একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেয়া হয়েছে। আমরা বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও নিয়ম অনুসরণ করে তারা অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়নি। এটাও একটা বড় ধরনের অনিয়ম।’
তিনি বলেন, ‘নিয়মের বাইরে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করে। স্কুলের জন্য একটা সংখ্যা নির্ধারিত আছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর খবর নিয়ে জেনেছি যে, এখানে শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে ১০ লাখ টাকা লাগে। সেটা বন্ধ করার জন্য লটারি সিস্টেম চালু করি। দেখা গেছে, ভর্তির যে অনুমতি আছে, এর চেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি করে ফেলে। এটা আরও বড় অনিয়ম।’
‘আমরা শাখার অনুমোদন দেই না, দেখা যায় তারা (ভিকারুননিসা) শাখা খুলে ফেলেছে। এই তথ্যগুলো কেউ বলে না। কোনো অভিভাবক এসব বিষয়ে অভিযোগ করতে চান না।’
নুরুল ইসলাম নাহিদ আরও বলেন, ‘নানা কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমার সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি- আমাদের পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত ছিল, আমাদের কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এটা অপরাধ। এটা করে যারা শাস্তি পেয়েছেন, তো পেয়েছেন। আর যারা করবেন আরও বেশি করে শাস্তি পাবেন, আমরা এখন থেকে আরও বেশি অ্যালার্ট হব, আরও নজরদারি করব।’
তিনি বলেন, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে চেহারা মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়েছে, তা মানুষের দৃষ্টি খুলে দেবে। ইচ্ছা মতো যা খুশি করার যে প্রবণতা সেটা রুখে দেয়া সম্ভব হবে।’
‘এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক একটা সুনাম আছে। এক অর্থে বলা যায়, সামাজিক একটা স্ট্যাটাস আছে। এখন এর আসল চেহারা উন্মুক্ত হয়েছে। আমরা এই চেহারাটা খুলে দেব। যা যা করলে এর নাম সত্যিকার অর্থে ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেই চেষ্টা আমরা করব।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেখানে এক মাসের মধ্যে ভিকারুননিসার অনিয়ম যাচাই করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। এটা আমাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। আমরা এই নির্দেশ পালন করব। আজকের মধ্যেই কমিটি গঠন করে ফেলব।’
তিনি বলেন, ‘এই তদন্ত কমিটির একটি কপি আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেব। যেখানে দেয়ার দরকার তিনি দিয়ে দেবেন।’