নিউজ ডেস্ক: প্রতারণার জাল থেকে মুক্তি পেতে ঠাণ্ডা মাথায় নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়োগেন গোনসালভেসকে (২২) খুন করেছেন ঢাকা জজকোর্টের শিক্ষানবিশ আইনজীবী সখিনা বেগম সবিতা (২৬)। আর এই কিলিং মিশন সফল করতে তিনি খরচ করেছেন মাত্র ১১শ’ টাকা।
রোববার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে নটরডেম ছাত্র খুনের বিষয়ে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান।
এর আগে শনিবার রাতে রাজধানীর উত্তর মুগদা এলাকা থেকে সবিতাকে আটক করে র্যাব। তিনি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে ঢাকা জজকোর্টে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টারেও পড়ান।
জিজ্ঞাসাবাদে ইয়োগেন খুনের বিষয়ে সবিতা জানিয়েছেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকা থেকে ৪৫০ টাকা দিয়ে একটি ব্যাগ ও ৬৫০ টাকা দিয়ে তিনি একটি বটি কেনেন। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ১২ ফেব্রুয়ারি সুযোগ বুঝে সবুজবাগের বাসায় ইয়োগেনকে প্রথমে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে, পরে বটি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে প্রমাণ এড়াতে পোশাক পাল্টে পালিয়ে যান।
সবিতা কেন বন্ধুর ঘাতক
র্যাব-৩ এর সিও এমরানুল হাসান বলেন, নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়োগেনের সঙ্গে ২০১৩ সালে সবিতার পরিচয় হয়। এরপর ২০১৭ সালের দিকে তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
অ্যাডভোকেট জাফর উল্লাহ রাসেল নামে আরেক ব্যক্তি, যিনি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন। তিনি বর্তমানে জজকোর্টে অনুশীলন করছেন। ২০১৩ সালে স্টামফোর্ডের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে সবিতাকে র্যাগ দেন রাসেল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে গুরুতর মনোমালিন্য হয়। যদিও পরে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রাসেল পুওর পিপল হেল্প ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি সবিতাকে ওই সংগঠনের আজীবন রক্তদাতা সদস্য কার্ড সংগ্রহ করে দেন। রাসেলের মাধ্যমে এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতেন নটরডেম ছাত্র ইয়োগেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সবিতা র্যাবকে জানান, রাসেল এই সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের আড়ালে নানাভাবে তার সঙ্গে প্রতারণা করতে থকে। এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও করেন। আর এসব মামলার সাক্ষী করেন ঘনিষ্ঠ ইয়োগেনকে।
কিন্তু, মাদকাসক্ত ইয়োগেন এই ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সময় সবিতার কাছ থেকে টাকা নিতে থাকেন। না দিলে নানা ভয়ভীতি দেখাতেন।
র্যাব-৩ এর সিও আরও বলেন, ইয়োগেনের ধারণা ছিল, সাক্ষ্য দিতে রাজি হওয়ায় রাসেল তার ক্ষতি করতে পারেন। এজন্য তিনি সবিতাকে বলে একটি আলাদা বাসা ভাড়া নেন, যেটির অর্ধেক ভাড়া বহন করতে থাকেন এই শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
গত জানুয়ারিতে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে সবুজবাগের হিরাঝিল মসজিদের গলির একটি বাসা ভাড়া নেন। কিন্তু, ফেব্রুয়ারিতে ইয়োগেন মার্চ মাসের ভাড়া বাবদ ৮ হাজার টাকা অগ্রিম দাবি করেন সবিতার কাছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নেশা করার টাকা ও মোবাইল বিল বাবদ ইয়োগেন ২/৩ বার করে টাকা নিত বলে র্যাবকে জানান সবিতা।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, টাকা দিতে দিতে বিরক্ত হয়েই সবিতা ইয়োগেনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কিলিং মিশন সফল করতে ১১শ’ টাকা খরচে একটি ব্যাগ ও বটি কেনেন পুরান ঢাকা থেকে। ঘটনার দিন বিকেলে সখিনা ইয়োগেনকে হিরাঝিল গলিতে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর বাসাবো টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে একটি লাচ্ছির বোতল কেনেন। পরে মুগদা হাসপাতালের টয়লেটে গিয়ে বোরকা পরে হিরাঝিলের গলিতে যান। সেখান থেকে ইয়োগেনকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। তাদের একসঙ্গে বাসায় প্রবেশের দৃশ্য বাসার সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
যেভাবে হত্যা করা হয় ইয়োগেনকে
বাসায় প্রবেশের পর ইয়োগেন আবার জুস কিনতে দোকানে যান। এরই ফাঁকে সবিতা ওয়ানটাইম গ্লাসে লাচ্ছি ঢেলে তাতে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে ফেলেন। ইয়োগেন ফিরলে তাকে লাচ্ছি খেতে দেন। লাচ্ছি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে সবিতা ইয়োগেনকে বটি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন। পরে বোরকা ত্যাগ করে সালোয়ার কামিজ ও ওড়না পরে বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে মগবাজারে বান্ধবীর বাসায় যান সবিতা। সেখান থেকে তিলপাপাড়ায় যাওয়ার পর নিজের মোবাইল ফোন চালু করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে র্যাব- ৩ এর সিও এমরানুল জানান, পুলিশের চোখ এড়াতেই মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছিলেন সবিতা। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।