চৌধুরী আকবর হোসেন : রাজধানী ঢাকারাজধানীর বেশির ভাগ মানুষই ভাড়াটিয়া। বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির মালিকের কথাই হয় শেষ কথা। যদিও ভাড়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হওয়ার বিধান আছে। রাজধানীর অধিকাংশ বাড়ির মালিকই রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে গেটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখেন। এরপর ভাড়াটিয়ারা বাড়ি থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারেন না। এ কারণে অনেককেই পড়তে হয় দুর্ভোগে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় ধরনের দুর্যোগে এই ‘কঠোর নিয়মের’ কারণে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ বাড়িতে দিনের বেলায় নিরাপত্তার জন্য গেটে তালা দেওয়া থাকে। সেই তালার একটি করে চাবি থাকে ভাড়াটিয়াদের কাছে। তবে রাতে বাড়িওয়ালা মূল গেটে অতিরিক্ত তালা দেন এবং ওই তালার চাবি সাধারণত ভাড়াটিয়াদের দেওয়া হয় না। মালিকদের এই তালা দেওয়া হয় রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। এরপর কোনও প্রয়োজনে হলে চাবির জন্য যেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইতিবাচক সাড়া মেলে না। চাবি চাওয়ায় অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মীর মোফাজ্জল হোসেন মোস্তাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ শহরে বেশির ভাগ মানুষ ভাড়া থাকেন। কিন্তু ভাড়া থাকা এ মানুষগুলোর অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমতো নিয়ম করেন, যা মানতে হয় ভাড়াটিয়াদের। ১১টার পর গেট বন্ধ করার নিয়ম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনও ঘটনা শুনেছি, কেউ পরিবারের অসুস্থ সদস্যকে রাতে হাসপাতালে নিতে গেটের চাবি চাইতে গেছেন, কিন্তু বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এমনও হতে পারে বাড়িওয়ালার ঘরে থেকেই অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, তখন তাদের উদ্ধার করে বের করে নিতে হলেও গেটের তালা ভাঙতে হবে। সব সময় হাতের কাছে গেটের তালা ভাঙার উপকরণ তো থাকে না।’
মিরপুর এলাকার ভাড়াটিয়া মনিরুল ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘একদিন রাতে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরতে রাত ১১টা পার হয়ে যায়। বাড়িওয়ালার দরজার কলিং বেল বাজিয়ে, ফোন দিয়েও সাড়া পাচ্ছিলাম না। এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মাকে নিয়ে। বাড়িওয়ালা পরে গেট খুলে দিয়েছেন, তবে অনেক খারাপ ব্যবহারও করেছেন।’ নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি এভাবে, ‘প্রতিবাদও করতে পারিনি, তাহলে বাসা ছাড়তে বলবেন। আবার বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও গেলেও তো সেই একই অবস্থা!’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা কারণে দুর্যোগে মানুষ আহত বা নিহত হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাস্থল থেকে মানুষজনকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে না পারার কারণে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে। রাতে গেট যদি বন্ধ হয়, আর আগুন বা ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে মানুষ দ্রুত বের হতে পারবে না। গেটের কাছে গিয়ে আটকে থাকবে। যেকোনও দুর্ঘটনায় হতাহত কমবে শুধুমাত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষজনকে সরানো গেলে। এ কারণে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু দুর্যোগে নয়, নানা কারণে রাতে বের হওয়া জরুরি হতে পারে। ফলে নিরাপত্তার কারণে গেট বন্ধ করা হলেও সবাই যেন বের হতে পারে— সেটির ব্যবস্থা করতে হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্যোগে যত দ্রুত রিসকিউ করা সম্ভব হবে, তত বেশি ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। চুরি, ডাকাতিসহ অন্যান্য বিষয়ের নিরাপত্তার জন্য তালা দেওয়া হয়। কিন্তু একই সঙ্গে যারা ভাড়া থাকেন তাদের জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তালা দিলেও বাড়ির মালিকদের উচিত ভাড়াটিয়াদের কাছে চাবি দেওয়া, অথবা নিরপত্তা প্রহরী রাখা। আমরা এ বিষয়টি সমাধান ও বিল্ডিং কোডে অন্তর্ভুক্তির জন্য রাজউকের কাছে সুপারিশ করবো।’
রাজধানীর মোম্মদপুরের একটি বাড়ির মালিক মজিবুর রহমান বলেন, ‘বাড়ির গেটে তালা দেওয়া হয় ভাড়াটিয়াদের নিরাপত্তার জন্য। আর কেউ বিপদে-আপদে চাবি চাইলে তো দেওয়া হয়ই। অন্য বাড়ির মালিকরা কী করেন, আমি জানি না। তবে এটা ঠিক বড় ঘটনা ঘটলে বাড়ি থেকে দ্রুত বের হওয়া জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে তো বিষয়টি ভাবিনি। দেখি, সামনে ভাড়াটিয়াদের চাবি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন